মাসটেকটমি কী
মাসটেকটমি অপারেশন হলো পুরো স্তন কেটে ফেলা। যুগ যুগ ধরে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা কার্যকর হিসেবে চলে আসছে। আগেকার দিনে রেডিক্যাল মাসটেকটমি অপারেশন করা হতো। এ পদ্ধতিতে পুরো স্তন, বগলের নিচের সব টিস্যু এবং স্তনের নিচের ও বুকের পাঁজরের ওপর এঁটে থাকা মাংসপেশি তুলে আনা হতো। যত বেশি টিস্যু অপারেশন করে ফেলা যায় ততই রোগমুক্ত থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এত বড় অপারেশনের ধকল কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন হতো এবং শরীরের আকারও বিকৃত হয়ে যেত। সেকালের রোগীরা এ ধরনের অপারেশনকে প্রচণ্ড ভয় পেত।
বর্তমানে রেডিক্যাল মাসটেকটমির আর প্রচলন নেই। অতিসম্প্রতি ত্বক রক্ষা করে মাসটেকটমি অপারেশন (স্কিন স্পেয়ারিন মাসটেকটমি) পদ্ধতি চালু হয়েছে। এ অপারেশনে একই সঙ্গে স্তন কেটে ফেলা এবং স্তন পুনর্গঠন সার্থকভাবে করা যায়।
মাসটেকটমি করার আগে
মাসটেকটমি করার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে নিতে হয়। তাই অপারেশনের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সার্জনের উপদেশ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আপনার সব ওষুধের একটি তালিকা তৈরি করুন এবং অপারেশনের আগে সার্জনকে বলুন। কারণ কোনো কোনো ওষুধে অপারেশনের সময় সমস্যা দেখা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এসপিরিন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। কিছু ওষুধ অপারেশনের সপ্তাহখানেক আগেই বন্ধ করে দিতে হয়।
অপারেশনের আগের রাতে (মধ্যরাতের আগেই) সব ধরনের খাবার বন্ধ করে দিতে হবে। অপারেশনের বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিতে হবে। যে বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে তা হলো-
— অপারেশনের ও অ্যানেসথেসিয়ার ঝুঁকি বর্ণনা করা হয়েছে কি না।
— অপারেশনের সময় ও অ্যানেসথেসিয়া করার জন্য কী কী ওষুধ প্রয়োগ করা হবে।
রক্ত দেওয়া হবে কি না।
— অপারেশনের কেটে ফেলা টিস্যু পরীক্ষা করা বা ফেলে দেওয়ার পর আপনাকে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে। লামপেকটমি ও মাসটেকটমি অপারেশনে খুব কমসংখ্যক রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু কোনো কোনো স্তন পুনর্গঠন অপারেশনে রক্ত দেওয়া জরুরি হয়ে যায়।
— অ্যানেসথেসিওলজি চিকিৎসক অপারেশনের আগে আপনার রোগের ইতিহাস নিয়ে আপনাকে শারীরিক পরীক্ষা করবেন। আপনার অবস্থা অনুযায়ী অজ্ঞান করার জন্য ওষুধ নির্বাচন করবেন।
যে বিষয়গুলো অ্যানেসথেসিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-
— রোগের ইতিহাস এবং হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহের কোনো সমস্যা।
— ত্বকের প্রদাহ, সর্দি, কাশি, দাঁতের ক্ষয় বা ইনফেকশন; কোনো অ্যালার্জি, ধূমপান বা অ্যালকোহল পানের অভ্যাস; যেসব ওষুধ ব্যবহার করে আসছেন তার তালিকা তৈরি।
অপারেশনের পদ্ধতি
প্রথমে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আপনার বাহুর শিরায় ছোট সুচ বসিয়ে আইভি লাইন চালু করবেন। কাজে সহায়তার জন্য আপনাকে শান্ত থাকতে হবে এবং শরীরকে শিথিল রাখতে হবে। সার্জন তাঁর দল নিয়ে যখন অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হবেন, তখনই আপনাকে অপারেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হবে। বিভিন্ন প্রকার যন্ত্র আপনার শরীরে বসানো হবে, যেমন অটোমেটিক রক্তচাপ মেশিন, হার্ট মনিটর, ব্লাড অক্সিজেন মনিটর ইত্যাদি।
অ্যানেসথেসিওলজি বিশেষজ্ঞ আপনার শিরায় ওষুধ দেওয়ামাত্র আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন। মুখের ভেতর দিয়ে শ্বাসনালিতে একটি টিউব বসানো হবে, যাতে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ পরিষ্কার থাকে। অপারেশনের সময় রক্তচাপ, নাড়ির গতি এবং শ্বাস-প্রশ্বাস সব সময় সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
মাসটেকটমি অপারেশনে দু-তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। স্তন টিস্যু ওপরে কণ্ঠহাড় থেকে নিচে বুকের পাঁজরের হাড় পর্যন্ত এবং পাশে বুকের মধ্যভাগ থেকে বগলের নিচে পেছনের মাংসপেশি পর্যন্ত বিস্তৃত। স্তনের দুই পাশে ডিম্বাকৃত করে ইনসিশন (ছেদন) করা হয়, যাতে স্তন টিস্যুকে পাঁজর থেকে আলাদা করা যায়। পরে সার্জন স্তন টিস্যু কেটে বের করে আনেন। স্তনের চাকা খুব ছোট না হলে স্তনের প্রায় সব ধরনের অপারেশনের সঙ্গে সঙ্গে বগলের লসিকাগ্রন্থি কেটে বের করা হয়।
স্তনে ক্যান্সার হলে ক্যান্সারকোষ খুব সহজেই লসিকানালির মাধ্যমে বগলের লসিকাগ্রন্থিতে ছড়িয়ে যায়। কেটে ফেলা সব স্তন টিস্যুই প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য প্যাথলজিস্টের কাছে পাঠানো হয়। অপারেশনের পর স্তন বা স্তনের পিণ্ড ও বগলের লসিকাগ্রন্থিগুলোর হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা এবং অন্যান্য বায়োলজিক্যাল পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরীক্ষার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য চিকিৎসার প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা নির্ভর করে।
যদি একই সঙ্গে স্তন পুনর্গঠন অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি থাকে, তাহলে এরপর প্লাস্টিক সার্জন তাঁর কাজ শুরু করবেন। অপারেশনে আরও এক ঘণ্টা থেকে ছয়-সাত ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। মাসটেকটমি অপারেশন করার পর একটি বা দুটি ড্রেন টিউব ত্বকের নিচে বসানো হয়। যাতে অপারেশনের স্থানে জমে থাকা তরল (সেরোমা) বাইরে বের হয়ে আসতে পারে। যদি ড্রেন টিউবসহ আপনি বাড়ি ফিরে যান তাহলে বিষয়টির যত্ন সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেবেন।
ভালো করে হাত ধুয়ে, সাকসান বাল্বটি ড্রেন টিউব থেকে আলাদা করে দিন। এবার ভালোভাবে লক্ষ করুন, বাল্বে জমে থাকা তরলের রং কী ও পরিমাণ কত এবং তা নোটখাতায় লিখে রাখুন। এবার বাল্বের তরল ঢেলে ফেলে দিন এবং বাল্বটি চেপে চেপে তরল ও বাতাস বের করে দিন।
এ অবস্থায় বাল্বটি আবার ড্রেন টিউবের সঙ্গে সংযোগ করে দিন। বায়ুশূন্য বাল্বটি আলতোভাবে ড্রেন টিউবের তরল টেনে বের করে নেয়। এভাবে ৫-১০ দিনে তরল জমা বন্ধ হয়ে যায়।
মাসটেকটমির পরে···
অপারেশনের পর রোগীকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফিরে এলে শরীরে ঠান্ডা বোধ হতে পারে। অজ্ঞান করার সময় গলায় যে টিউব বসানো হয়, তার জন্য গলায় ব্যথা হতে পারে। কয়েক ঘণ্টা তন্দ্রাচ্ছন্ন (আধো ঘুম আধো জাগরণ) ভাব থাকে।অপারেশন যা-ই হোক, প্রতিটি মানুষ অপারেশনের পরপরই তার প্রিয় মুখ দেখতে চায়। আ
পনার কিছু জানতে ইচ্ছে করলে সার্জনকে জিজ্ঞেস করতে পারেন এবং প্রিয়জনকে দেখতে চাইলে তাকে আনার জন্য অনুমতি নিয়ে দেখা করতে পারেন।
মাসটেকটমির পর প্রায় সব রোগীকে দু-এক রাত হাসপাতালে থাকতে হয়। কিন্তু মাসটেকটমির সঙ্গে স্তনের পুনর্গঠন অপারেশন হলে আরও বেশি দিন হাসপাতালে থাকতে হয়।
অপারেশনের পর একেকজন একেকভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখায়। অপারেশনের আগে যে রকম ভয় ভয় ভাব থাকে, অপারেশনের পর তা অনেকটা দূর হয়ে যায়। অনেকে স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করতে সক্ষম হয় এবং সুস্থ হয়ে ওঠে।
বাড়ি ফিরে এলে শারীরিকভাবে হয়তো কিছুদিনের জন্য দুর্বলতা থাকতে পারে। তা অল্প দিনেই সেরে যায়।কারণ অ্যানেসথেসিয়া (অজ্ঞান) এবং একটি বড় অপারেশনের পর ক্লান্তি বোধ হওয়া বা দুর্বলতা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
অপারেশনের স্থান না শুকানো পর্যন্ত সারা শরীরে পানি ঢেলে গোসল করা যাবে না। তবে মাথায় পানি দেওয়া যাবে, ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মোছা যাবে (স্পঞ্জ বাথ) কিন্তু অপারেশনের স্থানে পানি লাগানো যাবে না।
অপারেশনের পরপরই সংলগ্ন বাহুর নড়াচড়ায় খুব অসুবিধা হয়। কারণ অপারেশনের ক্ষত থাকায় বুক ও বাহুর মাংসপেশিতে জড়তা থাকে। বাহুর নড়াচড়া স্বাভাবিক করার জন্য অপারেশনের পর থেকেই চেষ্টা করতে হবে।
অনেক মহিলাই অপারেশনের ধকল কাটিয়ে ওঠার পরপরই কাজে যোগদান করে থাকেন। এমনকি কর্মরত অবস্থায় রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি চিকিৎসা চালিয়ে যান।
তবে আপনার কাজ যদি এমন হয় যে হাত দিয়ে অনেক ভারী জিনিস ওঠাতে হবে বা টানাটানি করতে হবে, সে ক্ষেত্রে হাতের জোর সম্পূর্ণ ফিরে না আসা পর্যন্ত সাময়িকভাবে ওই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে অথবা কাজ পরিবর্তন করে নিতে হবে। বগলের লসিকাগ্রন্থি কেটে (এক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশন) বের করা হলে, বগলের নিচে এবং বাহুর ভেতরের দিকে বোধশক্তি কিছুটা লোপ পায়। কারণ অপারেশনের সময় ওই এলাকার স্মায়ুতে (নার্ভ) আঘাত হতে পারে। যদি এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে বগলের নিচে শেভ করার সময় খুবই সতর্ক হতে হবে।
এ রকম অবশ বোধ কয়েক মাস থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই সেরে যেতে পারে। কিন্তু আগের মতো স্বাভাবিক বোধশক্তি নাও ফিরে আসতে পারে। বগলের লসিকাগ্রন্থি অপারেশনের আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বাহু ফুলে যাওয়া বা আর্ম ইডিমা। এর কারণ রেডিওথেরাপি চিকিৎসা বা অপারেশনের সময় লিম্ফ-নালিতে কোনো ক্ষত হওয়া। ফলে লিম্প-প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হাত ফুলে ওঠে। (চলবে)
ডা· পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০০৮
Leave a Reply