ডা· আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
চঞ্চলতাই শিশুদের বৈশিষ্ট্য। শিশু হবে হাসিখুশি, দুরন্ত। কিন্তু চঞ্চলতাকে ছাপিয়ে একটি শিশু যখন অতিমাত্রায় অমনোযোগী হয়ে ওঠে, বাড়ি বা স্কুল কোথাও মুহূর্তের জন্য মনঃসংযোগ করতে না পারে, তখন সে মা-বাবার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে যায়। শিশুর এ ধরনের অমনোযোগিতা আর সেই সঙ্গে অতিরিক্ত অস্থিরমতি হওয়াটা অসুস্থতা হিসেবে ধরা হয়। এ রোগটিকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভ ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) বা হাইপারকাইনেটিক ডিসঅর্ডার। অর্থাৎ ‘অতিচঞ্চল অমনোযোগী শিশু’।
এ সমস্যা হলে শিশুর মধ্যে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। বাবা-মা বা স্কুলের শিক্ষক সবার আগে এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেন। সাধারণত ছয়-সাত বছর বয়সের আগেই এ রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। অতিচঞ্চল অমনোযোগী শিশু শনাক্ত করতে হলে দেখুন তার মধ্যে নিচের লক্ষণগুলো আছে কি নাঃ
— খুব বেশি মাত্রায় অমনোযোগিতা, কোনো কিছুর প্রতি বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।
— অতিরিক্ত দুরন্তপনা, প্রায় সারাক্ষণ ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি।
— চিন্তা না করেই আবেগবশত হঠাৎ কোনো কাজ করা।
এ রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ নিয়ে নানা মত রয়েছে। প্রত্যক্ষ কোনো বিশেষ কারণ জানা না গেলেও বলা হয়, মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অংশে কিছু রাসায়নিক পদার্থের (নিউরোট্রান্সমিটার) অস্বাভাবিকতার জন্য শিশুর এমন আচরণ হয়ে থাকে। এ ছাড়া রোগটির সঙ্গে বংশগতির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেসব শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠে কিংবা শিশুসদনে বা আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বড় হয়, তাদের মধ্যে এ সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় বেশি। সম্প্রতি কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, জিঙ্কের (খনিজ খাদ্য-উপাদান) ঘাটতি ও খাদ্যদ্রব্যে কৃত্রিম রঙের কারণেও এডিএইচডি হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মায়ের ধূমপান বা মাদক সেবনের কারণেও সন্তানের এ সমস্যা হতে পারে। আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে এ রোগের হার ১·৭ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত। মেয়েশিশুদের তুলনায় আক্রান্ত ছেলেশিশুদের সংখ্যা তিন গুণ বেশি।
এ রোগে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে অমনোযোগিতা, অতিরিক্ত দুরন্তপনা, হঠকারী কাজ করার প্রবণতা প্রভৃতি লক্ষণের সব কটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একসঙ্গে থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ প্রকটভাবে নাও থাকতে পারে। যেমন দেখা গেল, শিশু অমনোযোগী ঠিকই কিন্তু তেমন দুরন্ত নয়। আবার কেউ বা হঠাৎ কোনো কিছু করে ফেলে আর দুরন্তও বটে কিন্তু পড়াশোনায় মোটামুটি মনোযোগ দিতে পারে।
এ রোগে আক্রান্ত শিশুটি চঞ্চলতার কারণে সাধারণত একদণ্ড স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি, হাত-পা ছোড়াছুড়ি, লাফিয়ে উঁচু জায়গায় উঠে যাওয়া, খাট-টেবিলের ওপর থেকে লাফ দেওয়া-এসব চলতেই থাকে। নিজের বাসায়, অন্যের বাসায়; এমনকি স্কুলেও। যেকোনো প্রশ্ন শোনার আগেই তার জবাব যেন তৈরিই থাকে।
কেউ বা সারাক্ষণ বকবক করতেই থাকে। পড়াশোনা তো বটেই, এমনকি খেলাধুলাতেও সে মনঃসংযোগ রাখতে পারে না; একটি খেলা শেষ না করেই আরেকটি শুরু করে দেয়। সব সময় সে যেন একটা তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকে। বড়রা কোনো কাজ করতে থাকলে বা কথা বলতে থাকলে সেখানে বাধা দেয়। একসঙ্গে অনেক কিছু করার চেষ্টা সে করে থাকে।
অমনোযোগিতার মাত্রা সব সময় এত বেশি হয় যে সাধারণ কোনো নির্দেশও সে অনুসরণ করতে পারে না। বাসার খেলা, পড়া আর স্কুলের পড়ার দিকে তার কোনো মনোযোগ থাকে না। বাড়িতে তার ব্যক্তিগত জিনিস, খেলনা গুছিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি স্কুলে নিজের বই-খাতা-পেনসিল ঠিকমতো গুছিয়ে নিতে পারে না।
কোনো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে ওঠে। যে কাজগুলো করতে গেলে সামান্য পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় সেগুলো শিশুটি করতে পারে না। ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করতেও হিমশিম খায়। খেলা করছে, হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক কোনো শব্দ বা দৃশ্য তার মনকে খেলার দিক থেকে সরিয়ে নিতে পারে।
একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, তা হলো-সাধারণ চঞ্চলতাকে যেন এডিএইচডি মনে করা না হয়। শিশুর চঞ্চলতা তার স্বাভাবিক প্রবণতা কিন্তু ওপরের লক্ষণগুলো যদি একটি সাত বছরের কমবয়সী শিশুর মধ্যে কমপক্ষে ছয় মাস ধরে দেখা যায় এবং নিজের বাড়ি, স্কুল বা অন্য বাড়ির মধ্যে অন্তত দুই জায়গাতেই তার দুরন্ত আচরণ অপরিবর্তিত থাকে, আর এগুলোর কারণে তার স্কুল ও পারিবারিক-সামাজিক পরিমণ্ডলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তখন তা রোগের পর্যায়ে পড়ে। এ লক্ষণগুলো অন্য কোনো শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে হচ্ছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
দেখতে হবে, শিশুটির আচরণ তার বয়সের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন দুই বছরের একটি শিশু চুপচাপ বেশিক্ষণ একটি চেয়ারে বসে থাকবে, এটা কেউ আশা করে না। কিন্তু ছয় বছরের একটি শিশু যদি স্কুলে গিয়ে নির্দিষ্ট আসনে বসে না থেকে শ্রেণীকক্ষ ধরে ছোটাছুটি করে, তবে তা অস্বাভাবিকই বটে।
আবার নিজের বাড়িতে যদি কেউ একটু বেশি দুরন্ত কিন্তু স্কুল বা অন্যের বাসায় নিতান্তই শান্ত থাকে, তবে তাকে অসুস্থ বলা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে এ রোগ শনাক্ত করতে পারেন বিশেষজ্ঞ মনশ্চিকিৎসক। কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশীর কথায় নিজের শিশুকে অযথা রোগী ভাববেন না।
যদি শিশুর মধ্যে এ রোগের লক্ষণ থেকে থাকে তাহলে ভয় না পেয়ে নিকটস্থ হাসপাতাল বা মনশ্চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এ রোগের জন্য রয়েছে ওষুধ ও আচরণ পরিবর্তনকারী বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ (বিহেভিয়ার থেরাপি)। এ ছাড়া রয়েছে মা-বাবার জন্য প্রশিক্ষণ, সামাজিক প্রশিক্ষণ, বিশেষ খাদ্যতালিকা আর স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা। অনেক ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বয়ঃসন্ধিকালের মধ্যেই এ রোগের লক্ষণগুলো কমে আসে। তবে কখনো কখনো তা প্রাপ্তবয়সেও বজায় থাকে এবং কিছু মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে এ রোগের চিকিৎসা করাটা জরুরি।
অতিচঞ্চল অমনোযোগী শিশুর মা-বাবার দায়িত্ব অনেক। শিশুদের জন্য যে কাজগুলো তাঁরা যা করতে পারেন তা হচ্ছেঃ
— রুটিন তৈরি করে দেওয়াঃ শিশুটির দৈনন্দিন কাজের জন্য (ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত ব্রাশ করা, খাওয়া, পড়া, খেলা, টিভি দেখা) একটি রুটিন করে দেওয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা। শিশুর আচরণের পরিবর্তন হলে রুটিনটিও পরিবর্তন করা।
— বাসার জন্য নিয়ম তৈরি করাঃ বাসার সবার জন্য সাধারণ পালনীয় কিছু নিয়ম তৈরি করা। শিশুটির পাশাপাশি অন্য সদস্যরাও এ নিয়মগুলো পালন করবে। এতে শিশুটি বড়দের দেখে নিয়মমাফিক কাজ করা শিখবে।
— নির্দেশনা বুঝিয়ে দেওয়াঃ এ নির্দেশনাগুলো শিশু ঠিকমতো বুঝতে পারে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। যেহেতু তার মনোযোগ কম, তাই কখনোই আশা না করা যে সে সবকিছু একবারে বুঝে ফেলবে। এ জন্য তাকে সময় দিতে হবে, রূঢ় আচরণ করা যাবে না।
— ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করাঃ নির্দেশনা পালন করলে শিশুটিকে পুরস্কার (যেমন প্রশংসাসূচক বাক্য বলা, ফুল বা চকলেট দেওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া) দেওয়া আর নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তির বদলে পুরস্কার প্রত্যাহারের ব্যবস্থা রাখা।
— শিশুর প্রতি মনোযোগঃ শিশুর প্রতি মনোযোগ দেওয়া। তার আচরণগুলো তদারক করা। অনেক সময় হঠকারী হয়ে শিশুটি ক্ষতিকর কিছু করে বসতে পারে। এ জন্য তার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা।
— বন্ধুবান্ধবের সহায়তাঃ সামাজিক নিয়মনীতি শিখতে পরিবারের পাশাপাশি তার বন্ধুদেরও প্রয়োজন। তাই সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে ও খেলতে তাকে উৎসাহিত করা।
— প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্ব দেওয়াঃ শিশুটি যে বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে বা রুটিন পালন করছে, সে চেষ্টাটুকুর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা। তার ফল ভালো হচ্ছে কি না, তার অর্জন কতটুকু-সেটা বড় বিবেচ্য নয়, আচরণ পরিবর্তনে তার চেষ্টাটাই আসল।
— ডায়েরি ব্যবহারঃ শিশুটির যদি কিছুটা লেখার মতো বয়স হয়, তাহলে তার দৈনন্দিন কাজগুলো একটি ডায়েরিতে লিখে রাখতে উৎসাহিত করা।
— শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করাঃ শিশুর সমস্যা নিয়ে তার স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা। চিকিৎসকের মন্তব্য শিক্ষককে জানানো এবং তাঁর সাহায্য চাওয়া। প্রয়োজনে শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়া।
— খাদ্যতালিকা ও ব্যায়ামের দিকে দৃষ্টিঃ চিকিৎসকের পরামর্শমতো তাজা ফলসহ শিশুর খাদ্যতালিকা তৈরি করা এবং হালকা ব্যায়াম ও খেলাধুলায় তাকে উৎসাহ দেওয়া।
— রূঢ় আচরণ না করাঃ শিশুর সমস্যাটি রোগ হিসেবে মেনে নেওয়া। তাকে অপরাধী না ভাবা। কোনো দুরন্ত আচরণের প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতি রূঢ় আচরণ (কঠোর ভাষায় বকা দেওয়া, মারধর করা, নৃশংস শাস্তি দেওয়া, ঘরে তালা দিয়ে রাখা, হাত-পা বেঁধে রাখা) করা থেকে বিরত থাকা। এ ধরনের আচরণ তার সমস্যা আরও প্রকট করে তুলতে পারে। প্রয়োজনে তাকে ধৈর্য ধরে বারবার বুঝিয়ে বলা।
যে কথাটি আবারও বলা প্রয়োজন, চঞ্চল শিশু মাত্রই অসুস্থ শিশু নয়। চঞ্চলতা ও অমনোযোগিতার কারণে যদি কোনো শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। গড়ে তুলুন হাসিখুশি সুন্দর শিশু, যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৬, ২০০৮
Leave a Reply