খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ফারহানা মোবিন
হৃৎপিণ্ড শরীরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হৃৎপিণ্ডের কাজ সারা দেহে রক্ত সঞ্চালন করা। হৃৎপিণ্ডকে গ্রিক ভাষায় বলে কারডিয়া (ঈথড়নমথ) আর ল্যাটিন ভাষায় কর (ঈসড়)। কর থেকেই করোনারি শব্দের উৎপত্তি। করোনারি মানে হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ডকে ইংরেজিতে বলে হার্ট আর সাহিত্যের ভাষায় হৃদয়
বা অন্তর।
অনেকেই মন বলতে হৃৎপিণ্ডকে বোঝায়। কিন্তু মন নামে আমাদের দেহে আলাদা কোনো অঙ্গ নেই। মানুষের মানসিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে তার মস্তিষ্ক। হৃৎপিণ্ড কোনাকৃতির, লালচে মাংসল অঙ্গ। বুকের বাঁ দিকে এবং দুই ফুসফুসের মধ্যে এর অবস্থান। বাঁ বগলের গোড়া থেকে তিন বা চার ইঞ্চি দূরে হৃৎপিণ্ডের মাথা অবস্থিত। হৃৎপিণ্ড যকৃতের বাঁ দিকের কিছু অংশ স্পর্শ করেছে। পুরো হৃৎপিণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশ বাঁ দিকে আর এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে ডান দিকে।
এর দেহ পেরিকার্ডিয়াম নামে দ্বিস্তরবিশিষ্ট পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত। হৃৎপিণ্ডকে হাতের পাঁচ আঙুলের মধ্যে নেওয়া যায়। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের হৃৎপিণ্ডের ওজন ২৮০ থেকে ৩৪০ গ্রাম আর নারীর ২৩০ থেকে ২৮০ গ্রাম।
এর দেহকে প্রধান চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলোকে যথাক্রমে ডান অলিন্দ, বাঁ অলিন্দ, ডান নিলয়, বাঁ নিলয় বলে। আর রয়েছে অনেক শিরা, উপশিরা, ভাল্ভ ও ধমনি। শিরা, উপশিরায় তৈরি রক্তবাহী মাংসল থলেকে বলে ভাল্ভ।
ভাল্ভগুলোর নাম বাইকাসপিড, ট্রাইকাসপিড এবং এক জোড়া সেমিলুনার। এ ভাল্ভ ও হৃৎপিণ্ডের সব শিরা, উপশিরা সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। পানির মেশিন যেমন উঁচু দালানের প্রতিটি পাইপে পানি সরবরাহ করে, ঠিক তেমনি হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করে সারা দেহে পাঠায়।
এ জন্য একে ‘রক্ত পাম্পকারী যন্ত্র বা শরীরের পাম্পমেশিন’ বলা হয়। এই অঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্ত আসে আর হৃৎপিণ্ড সেই রক্তকে অক্সিজেন যুক্ত করে সারা দেহে পাঠায়। রক্ত পাম্প করার জন্য ভাল্ভগুলো প্রতি সেকেন্ডে খোলে আর বন্ধ হয়। ফলে তৈরি হয় হৃৎস্পন্দন বা হার্ট বিট।
হৃৎপিণ্ড প্রতি মিনিটে ৭০-৮০ বার স্পন্দন দেয়। এই হার্ট বিটের শব্দ স্টেথিস্কোপ দিয়ে শোনা যায় (ঢিব ঢিব করে)। ঘুমন্ত অবস্থায়ও হৃৎপিণ্ড কাজ করে। গর্ভাবস্থা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের হার্ট বিট শোনা যায়।
হৃৎপিণ্ডের যত্নে কী করবেন
— হৃৎপিণ্ড কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত রক্তকে অক্সিজেনযুক্ত রক্তে পরিণত করে সারা শরীরে পাঠায়। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা সঠিক থাকলে প্রতিটি অঙ্গ ভালোভাবে কাজ করে। এর জন্য সর্বদা চিন্তামুক্ত থাকুন। ঘরে আলো-বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করুন।
— দেহের কাঠামো, বয়স বিবেচনা করে চর্বিমুক্ত খাবার খান। চর্বিযুক্ত খাবারের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা হৃৎপিণ্ডের শিরা, উপশিরার দেয়ালে জমে রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ব্লকেজ হয়। (ব্লকেজ মানে শিরা, উপশিরা বা ধমনির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া।) এর জন্য প্রচুর পরিমাণে সুষম খাবার খান।
— মাদকদ্রব্য হৃৎপিণ্ডর মারাত্মক ক্ষতি করে। সিগারেটের নিকোটিন রক্তনালির ছিদ্রকে ছোট করে দেয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। তাই হৃৎপিণ্ডসহ দেহের সব অঙ্গের জন্য ধূমপান ও অন্য মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে দূরে থাকুন। অতিরিক্ত পরিশ্রম বা অলসতা ভালো নয়।
— গ্যাস্ট্রিক (উচ্চ মাত্রার) হৃৎপিণ্ডের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই গ্যাস্ট্রিকের রোগীরা অতিরিক্ত কড়া লিকারের দুধ চা, কফি, সোডাযুক্ত খাবার, পান, জর্দা, গুল বর্জন করুন।
— অনেকেরই মাঝেমধ্যে বুকে ব্যথা হয়। বাঁ দিকে হাত দিয়ে চেপে ধরলে ব্যথাটা কম লাগে। বুক ধড়ফড় করে, দুর্বলতা অনুভূত হয়। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে এমন হয়। এ সমস্যা ইসিজিতে ধরা পড়ে না। সামান্য এ সমস্যার জন্য অনেকেরই কষ্ট হয়। এ জন্য দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণ সঠিক রাখতে হবে। দেহের গঠন ও উচ্চতা বুঝে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। মৌসুমি ফল ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে।
— অতিরিক্ত ভাত, আলু দেহে লিপিডের (চর্বি) পরিমাণ বাড়ায়। তাই ভাতের পরিমাণ কমিয়ে সালাদ খাওয়ার অভ্যাস করুন।
— নিয়মিত ব্যায়াম বা মুক্ত বাতাসে হাঁটা বেশ ভালো। এতে হৃৎপিণ্ডের কর্মতৎপরতা বাড়ে।
— দীর্ঘ বছর ধরে গর্ভনিরোধক পিল খাবেন না।
— হৃৎপিণ্ডকে বলা হয় ভাইটাল বা অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। ৪০-এর পর থেকে হৃৎপিণ্ডের নালিগুলো মোটা হয়ে যায়, তাই রক্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। একটুতেই বুকে ব্যথা করে। এ জন্য যথেষ্ট সতর্ক হোন। বছরে অন্তত একবার চেকআপ করান।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ৩০, ২০০৮
Leave a Reply