ডা· পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল মহাখালী, ঢাকা
স্তন ক্যান্সার দুইভাবে সার্জারি করা যায়-
এক· স্তন রেখে শুধু ক্যান্সার পিণ্ডটি কেটে ফেলা এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সার পিণ্ডের সংলগ্ন সুস্থ-স্বাভাবিক টিস্যুর কিছুটা কেটে বাদ দেওয়া। এ ধরনের সার্জারিকে বলে ওয়াইড লোকাল এক্সিশন বা লাম্পেক্টমি। স্তন রেখে সার্জারি করা হলে অপারেশনের পর অবশ্যই রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দিতে হবে। অপারেশনের পর স্তনে যদি কোনো ক্যান্সার কোষ থেকে থাকে, রেডিওথেরাপি চিকিৎসায় তা ধ্বংস হয়ে যায়।
দুই· পুরো স্তন কেটে ফেলাকে বলে মাস্টেক্টমি। আগেকার দিনে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীরা মাস্টেক্টমি অপারেশনকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন। কারণ, তখন মাস্টেক্টমি অপারেশন এখনকার মতো এত সহজ ছিল না। দিনে দিনে স্তন ক্যান্সার অপারেশনের পদ্ধতির অনেক উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে অপারেশনের ধকল
সহজেই কাটিয়ে ওঠা যায়। আধুনিক চিকিৎসায় স্তন কেটে ফেলে নতুনভাবে স্তন তৈরি করে পুনঃস্থাপনও করা যায়। তাতে দেহের সৌন্দর্য বজায় থাকে।
স্তন ক্যান্সার সার্জারির পদ্ধতি নিয়ে অনেক গবেষণামূলক কাজ হয়েছে এবং নিরন্তর গবেষণা চলছে। প্রমাণিত হয়েছে যে লাম্পেক্টমি মাস্টেক্টমির মতোই সমান কার্যকর। স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় কোন ধরনের সার্জারি বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করে রোগের প্রকার, স্তন ক্যান্সার পিণ্ডের আকার, রোগ দূরের অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কি না, সর্বোপরি রোগীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। এই প্রতিবেদন লাম্পেক্টমি নিয়ে।
লাম্পেক্টমি কী
স্তনে যদি একটি মাত্র ক্যান্সার পিণ্ড বা চিহ্ন থাকে এবং ক্যান্সার পিণ্ডটি যদি স্তনের অনুপাতে ছোট থাকে, তাহলে রোগী অপারেশনের চিকিৎসায় লাম্পেক্টমি বেছে নিতে পারেন। এ ধরনের অপারেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্তনের ক্যান্সার পিণ্ডটি সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলে দেওয়া এবং পাশাপাশি সুস্থ স্তন টিস্যু রক্ষা করে যতটা সম্ভব স্তনের স্বাভাবিক আকার-আকৃতি বজায় রাখা।
লাম্পেক্টমি অপারেশনে যে শুধু ক্যান্সার পিণ্ডটি ফেলে দেওয়া হয়, তা নয়। ক্যান্সার পিণ্ডের চারপাশের সুস্থ, স্বাভাবিক টিস্যুও কিছুটা ফেলে দেওয়া হয়। কতটা সুস্থ, স্বাভাবিক টিস্যু ফেলা হয়, তার জন্য সার্জারির বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
লাম্পেক্টমি অপারেশনের আগে···
লাম্পেক্টমি করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে স্তনে একটি মাত্র চাকা আছে। এ জন্য অবশ্যই ম্যামোগ্রাফি করাতে হয়। যদি স্তনের পিণ্ড বা চাকা হাত দিয়ে পরীক্ষা করে শনাক্ত করা না যায়, তাহলে বিশেষ ম্যামোগ্রাফি দিয়ে সুচ (তার) ফুটিয়ে আক্রান্ত স্থান নির্দেশ করা যায়। সার্জন সুচ বা তার অনুসরণ করে সহজেই অপারেশন করে ফেলেন।
সাধারণত হাসপাতালের অপারেশন রুম বা হাসপাতালের বহির্বিভাগের অপারেশন রুমেও লাম্পেক্টমি করা যায়। অপারেশনের পর সেই দিনই বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। অপারেশনের ভয় কাটানোর জন্য পরিবারের নিকটজন, বন্ধুবান্ধব এ সময় কাছে কাছে থাকতে পারেন।
অপারেশনের আগে আপনি অ্যানেসথেসিওলজিস্টের (বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যিনি অজ্ঞান করে থাকেন) সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন। জেনে নিতে পারেন অপারেশনের জন্য কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া করা হবে। সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হবে, নাকি শুধু যে স্থানের অপারেশন হবে, সে স্থানটুকু অবশ করে নেওয়া হবে। অপারেশনের বিষয়ে বিস্তারিত জেনে আপনাকে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে।
লাম্পেক্টমি অপারেশনের পদ্ধতি
এ অপারেশন সম্পন্ন করতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টার মতো। সার্জন ক্যান্সার পিণ্ডের ওপরকার ত্বকে অপারেশনের ব্লেড দিয়ে ছেদন করে ক্যান্সার পিণ্ডটি বের করে আনেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের চারদিক থেকে সংলগ্ন সুস্থ ও স্বাভাবিক টিস্যুও কেটে বাদ দিয়ে থাকেন। বাদ দেওয়া সুস্থ টিস্যুর পরিমাণ আধা ইঞ্চি থেকে পৌনে এক ইঞ্চি পুরু হয়ে থাকে। এতে ক্যান্সার কোষ থেকে যাওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।
অপারেশনে কেটে ফেলা সব টিস্যুই হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্যাথলজিস্টের (প্যাথলজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার) কাছে পাঠাতে হয়। প্যাথলজিস্ট অপারেশনের কেটে ফেলা টিস্যুকে মাইক্রোস্কোপিক্যাল পরীক্ষার জন্য উপযোগী করে পরীক্ষা করেন এবং প্রতিবেদন তৈরি করেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অপারেশনের কেটে ফেলা টিস্যুর চারদিকের পরীক্ষায় ক্যান্সারমুক্ত কি না সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। যদি এ পরীক্ষায় ক্যান্সার মুক্ত না হয়ে থাকে, তাহলে আবার লাম্পেক্টমি করতে হবে। কখনো বা পুরো স্তন কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।
লাম্পেক্টমি থেকে ভালো হওয়া
লাম্পেক্টমির পর আপনাকে কিছু সময় পোস্ট অপারেটিভ বা রিকভারি রুমে বিশ্রাম নিতে হবে। সার্জন ছুটির উপযুক্ত মনে করলে ওই দিনই ছুটি দিতে পারেন। লাম্পেক্টমি এবং একই সঙ্গে যদি বোগলের লিম্পনোড কেটে ফেলা না হয়, তাহলে অপারেশনের পরপরই স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবেন।অপারেশনের পরের উপদেশগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে। যেমন সার্জনের নির্দেশ অনুযায়ী অপারেশনের ক্ষত শুষ্ক রাখা, ফলোআপ পরীক্ষার জন্য এবং অপারেশনের সেলাই কাটার জন্য সার্জনের সঙ্গে দেখা করা।
(চলবে)
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ৩০, ২০০৮
Leave a Reply