অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
মায়ের দুধ যে শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার, এ ব্যাপারে আর দ্বিমত নেই। আবার মা যদি শিশুকে বুকের দুধ পান করান, তাহলে তা মায়ের জন্যও ভালো। পৃথিবীজুড়ে এখন বলা হচ্ছে, জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুকে শুধু বুকের দুধ দেবেন। এরপর পরিপূরক খাবারের সঙ্গে বুকের দুধ শিশুকে পান করাতে হবে দুই বছর বা এরও বেশি।
শিশুকে খাওয়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মায়ের বুকের দুধ। এতে শিশু যেমন উপকৃত হয়, তেমনি উপকৃত হয় মা, পরিবার ও সমাজ। তাই শিশুসন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার জন্য মায়েদের উৎসাহিত করতে হবে। লোকসমাজের দায়িত্ব হলো স্তন্যদানকে অবলম্বন দেওয়া, সহায়তা দেওয়া। শিশুর জীবনের শ্রেষ্ঠ সূচনা এভাবেই ঘটাতে হবে। তাই শিশুর মৃত্যুহার রোধ করতে গেলে, শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে জ্নের প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ দেওয়া অপরিহার্য। নানা দেশে স্তনের দুধ পানের হার উৎসাহব্যঞ্জকভাবে বাড়লেও বৈশ্বিক উপাত্ত থেকে জানা যায়, ইদানীং ছয় মাস বয়সের নিচে যাদের বয়স, সেসব শিশুর ৪০ শতাংশ শুধু বুকের দুধ পান করছে। বুকের দুধ দেওয়ার জন্য মায়েদের উৎসাহিত করা উচিত বলেছে ওয়াবা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর মাদার সাপোর্ট ফর ব্রেস্টফিডিং (জিআইএমএস)। মাদার সাপোর্ট হলো ‘মা ও শিশু দুজনের ক্ষেত্রেই মায়ের বুকের দুধ পান করার ও দেওয়ার চর্চাকে উন্নত করার উদ্দেশ্যে মাকে অবলম্বন দেওয়া।
মায়ের বুকের দুধ হলো শিশুর শ্রেষ্ঠ খাবার। শিশুর ক্রমবিকাশমান পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খায় এই খাদ্য, শিশুর দেহের ওজন বাড়া, দেহের বাড়ন ও বিকাশকে নিশ্চিত করে প্রকৃতির এই দান-মায়ের বুকের দুধ। প্রথম ছয় মাস বয়স বুকের দুধ হলো শিশুর একমাত্র খাবার। মায়ের শরীরের দেহপ্রতিরোধক অ্যান্টিবডিগুলো বুকের দুধের সঙ্গে শিশুর শরীরে এসে শক্তিশালী করে তোলে শিশুর দেহপ্রতিরোধ ব্যবস্থা।
শিশুর শ্বাসযন্ত্রের অসুখ, পাকস্থলী ও অন্ত্রের অসুখ অনেক কম হয় মায়ের বুকের দুধ পান করলে। অন্যান্য গুরুতর অসুখ থেকেও রক্ষা পায় শিশু। শিশুর দৈহিক বিকাশের চেয়েও অনেক বেশি উপকার হয় মায়ের বুকের দুধ পান করলে। গবেষণায় দেখা গেছে, বুকের দুধ পান করার মাধ্যমে মা ও শিশুর শারীরিক যে ছোঁয়া, এতে মা ও শিশুর মধ্যে এক অপূর্ব বন্ধন স্থাপিত হয়, শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ অনেক ত্বরান্বিত হয়।
তবে অনেকেই জানে মায়ের বুকের দুধ শিশুর শ্রেষ্ঠ খাদ্য। কিছু লোক এও জানে, বুকের দুধ শিশুকে দিলে মায়েরও স্বাস্থ্যের হিত হয়। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানে না যে মায়ের বুকের দুধ পান পরিবেশ রক্ষার জন্য ভালো।
— গো-পালন ও গৃহপালিত অন্যান্য পশু পালনের জন্য ধ্বংস হয় জমি, দূষিত হয় পানি ও বাতাস। নাইট্রেট সার, যা গরুর খাবার জোগানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। সেগুলো চলে যায় নদী ও জলাশয়ে। গরুর অসুখ হলে মিথেন গ্যাস বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে। এতে ক্রমেই ধ্বংস হতে পারে ওজোন স্তর। ভারতের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সেখানে মায়ের দুধের বদলে গরুর দুধ শিশুদের খাবার হলে প্রয়োজন হবে ১৩৫ মিলিয়ন দুগ্ধবতী গাভি। এদের গো-চারণভূমির জন্য ভারতের ৪৩ শতাংশ জমি প্রয়োজন হবে।
— কৃত্রিম খাদ্যগ্রহণ করলে অনেক বর্জ্য তৈরি হবে এবং মূল্যবান সম্পদ নিঃশেষিত হতে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুকে বোতলের দুধ খাওয়ালে প্রায় ৮৬ হাজার টন টিন প্রয়োজন হবে ৫৫০ মিলিয়ন দুধের ক্যান তৈরির জন্য। আরেকটি হিসাব বলি। ব্রিটেনে প্রতিটি মা যদি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে তিন হাজার টন কাগজ (ফর্মুলা লেবেলের জন্য) বেঁচে যাবে প্রতিবছর।
— বুকের দুধ পান চমৎকার জ্ননিরোধ হিসেবে কাজ করে, অথচ এতে খরচ নেই, স্বাস্থ্যসংকটও নেই। দুটো শিশুর জন্মের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও থেকে যায়।
— বুকের দুধ পান করালে জনসংখ্যা বিস্কোরণ রোধ হয়। বুকের দুধ শিশুকে পান করালে জন্মনিরোধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ যেমন হয়; তেমনি যে শিশুর জন্ম হয়, সে-ও থাকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ। ফর্মুলা দুধ যেসব শিশু খায়, তারা প্রায়ই অসুস্থ হয়, অসুস্থ হতে থাকে, তাদের মৃত্যুহারও বেশি। বুকের দুধ যেসব শিশু খায়, তাদের স্বাস্থ্য হিতকরী প্রভাব কেবল যে শৈশবেই দেখা যায় তা-ই নয়, দেখা যায় জীবনভর। মা-বাবারা যদি দেখেন, যে শিশুদের তাঁরা জ্ন দেবেন, এরা সুস্থভাবে পূর্ণ বয়স্ককালে উত্তীর্ণ হবে, তখন মা-বাবারা সন্তান নেবেনও কম। এভাবে হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ।
— প্রকৃতির এই দান মায়ের দুধকে সুরক্ষা করা উচিত। শিশুর কৃত্রিম গুঁড়ো দুধ খাদ্যের বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ওপর বিধিনিষেধ যেমন আরোপিত হয়েছে, তেমনি মায়ের দুধ পান ও একে উৎসাহিত করা ও সুরক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
প্রকৃতির সম্পদকে আমাদের রক্ষা করা উচিত-সে সম্পদ অরণ্য, সমুদ্র, এমনকি মানব শরীর, যেকোনো উৎস থেকেই আহরণ করা হোক না কেন। আমাদের সবার মা এই মাতৃপ্রকৃতিকে সম্মান করা ও মর্যাদা দেওয়া এবং লালনের জন্য আমরা যেসব উপায় অবলম্বন করেছি, এর সঙ্গে মাতৃদুগ্ধপানকে যোগ করলে প্রশংসার কাজ হয় বৈকি।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ৩০, ২০০৮
Leave a Reply