সুখী দাম্পত্যজীবনের মন্ত্র
‘বিবাহ’ শব্দটির মধ্যে আছে বহ্। যার মানে ‘বহন করা’। আর ‘বি’ উপসর্গের মানে হলো বিশেষরূপে। বিবাহ মানে, বিশেষরূপে বহন করা। সেটা স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকেও।
সারা জীবন এই ‘বিশেষরূপে বহন করে চলা’র পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঠোকাঠুকি, কথা-কাটাকাটি, মান-অভিমানের শেষ নেই। দুটি পাত্র পাশাপাশি রাখলে ঠোকাঠুকি হবেই। গুণীজনেরাই বলে গেছেন, ‘বিয়ে মানে নিজের অধিকারকে অর্ধেক করে কর্তব্যকে দ্বিগুণ করে নেওয়া।’ আর রবিঠাকুর? ‘…বীরত্ব করে লাভ কী? আঘাত করলেও কষ্ট, আঘাত পেলেও কষ্ট।’
সুখময় দাম্পত্যজীবন আসলে কী? সব সময়ই মধুর? নাকি ল্যাংড়া আমের মতো অম্লমধুর? আন্তরিকতা, ধৈর্য আর ভালোবাসার পাটাতনে ভর করে আপনি চাইলেই দাম্পত্য সম্পর্কটাকে সুখময় করে তুলতে পারেন।
যত্নবান হওয়াই দাওয়াই
অনেকে আছেন, দাম্পত্য সম্পর্ককে ততটা গুরুত্ব দেন না। ভাবখানা এমন যে এটা তো হওয়ারই কথা ছিল! আলাদা করে ভেবে কী লাভ?
দাম্পত্য সম্পর্কের চেয়ে তাঁদের কাছে কর্মক্ষেত্র, বন্ধুত্ব কিংবা অন্যান্য বিষয়ের অগ্রাধিকার বেশি। এটা মারাত্মক ভুল। কেননা দিন শেষে নিজের ঘরই মানুষের ঠিকানা। সেটা আপনার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আপনার বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও। সেই ঠিকানায় যে আপনার ফেরার প্রতীক্ষায় থাকেন, সে-ই আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হওয়ার ক্ষেত্রে তাই জীবনসঙ্গীর গুরুত্বই বেশি।
এই সম্পর্কের ওপর দাঁড়িয়েই প্রসারিত হবে আপনার জীবন। তাই জীবনসঙ্গীর ভাবনা-চিন্তা, পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যত্নশীল হওয়া জরুরি। দেখবেন, শুধুই এই যত্নবান হওয়ার জন্য আপনিও ঠিক একই আচরণ ফেরত পাচ্ছেন!
বিশ্বস্ততা
আপনি জীবনসঙ্গীর প্রতি ভীষণ যত্নবান। কিন্তু ঘরের বাইরে নিজের জীবনকে তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন প্রতিনিয়ত। এমন সম্পর্কের কোনো ভিত্তি আছে কি?
সমাজে সম্মানহানির ভয়ে এই ভিত্তিহীন সম্পর্ক নিয়েই অনেকে জীবন কাটিয়ে দেন একই ছাদের তলে। এমন সম্পর্ক আসলে শুধুই জীবনধারণের একটা পদ্ধতি, দাম্পত্যজীবন নয়।
কারণ, বিশ্বাস হলো প্রতিটি মানবিক সম্পর্কের ভিত্তি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তাই অবিশ্বাসের মূল উপড়ে বিশ্বাস স্থাপন ভীষণ জরুরি। তাঁর মনে নিজেকে মেলে ধরুন। নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে তাঁর যৌক্তিক মতামতকে গুরুত্ব দিন। সন্দেহ দুরে ঠেলে তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন। বিশ্বস্ততা আপনাকে কাছে টেনে প্রতিদানে সুখ ফিরিয়ে দেবে।
পারস্পরিক বোঝাপড়া
সংসার অনেকের কাছেই জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র। জিতলে উন্নতি, হারলে অধোগতি। তাহলে একটা প্রশ্ন, যুদ্ধে কিংবা খেলার ময়দানে সতীর্থদের মধ্যে বোঝাপড়া না থাকলে জয়ী হওয়া যায়?
জীবনযুদ্ধে জয়ের সুখ নিতে তাই দাম্পত্যজীবনেও বোঝাপড়া জরুরি। সকালে অফিসে গিয়ে বিকেলে আড্ডা মেরে ফিরছেন রাত ১০টায়। কোনো সমস্যা নেই, শুধু স্ত্রী অফিস থেকে দেরি করে ফিরলেই বিপত্তি, কিংবা তাঁর উল্টোটা। বোঝাপড়ার মাত্রা এত কম হলে সুখ পালাবে।
পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা এবং দুজন-দুজনের ব্যক্তিত্বকে জানতে পারলে ভালো। জীবনসঙ্গীর সৌন্দর্য চেনার থেকে জানাটা বেশি জরুরি। এতে বোঝাপড়া মজবুত হয়।
প্রত্যাশাহীন ভালোবাসা
এমন ভালোবাসা আবার হয় নাকি? এই যুগে দেওয়া-নেওয়াই সম্পর্ক। জীবনসঙ্গীর কাছে প্রত্যাশা থাকবে না?
অবশ্যই থাকবে। তবে ঠোকাঠুকি লেগে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসেবে গরমিল হলো কি না, তা এবার থেকে অন্তত প্রত্যাশা না করে দেখুন। অন্তত ছয় মাস তাঁর কাজ তাঁকে করতে দিন। যা খুশি বলুক, ভাবুক। কান না পেতে তাঁর প্রতি দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হন। আচরণে বুঝিয়ে দিন আপনি একটা ‘রিস্টার্ট’ চান।
অস্থিরচিত্ত ও স্বার্থপরদের জন্য এটা বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু তাঁর সঙ্গেই এক ছাদের নিচে থাকতে চাইলে এ স্রেফ ভালোবাসা। কিছুই বিঁধবে না। বরং অন্য প্রান্তে—ভালোবাসা কিছু অবশিষ্ট থাকলে—গজাবে! সবুর করলে সুখের মেওয়া ফলবেই; নতুবা বাগানটা আপনার নয়।
বন্ধুত্বের আবির
নিজেদের শুধু দায়িত্ব পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বন্ধু হয়ে যান। বন্ধুত্বে আছে সম্পর্কের সব ইতিবাচক রং। অন্তত একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুধু টাকাপয়সা, সৌন্দর্য দাম্পত্যজীবনকে সুখী করতে পারে না। কিন্তু বন্ধুত্বের সম্পর্কে মানুষ সারা জীবনই সুখী। তাই দাম্পত্য সম্পর্কে ছিটিয়ে দিন বন্ধুত্বের আবির। সুখ আসবেই!
শেষ কথা
সুমধুর দাম্পত্যজীবনে মান-অভিমানেও বুকে সুখের ব্যথা বাজে। সেই ব্যথাটুকু উপভোগ করতে চাইলে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলে ছাড় পাবেন। একসময় গিয়ে দেখবেন, কাউকেই আর ছাড় দিতে হচ্ছে না। দুজনেই শুধরে নিয়েছেন।
আসলে নিজেকে শুধরে নেওয়ার মধ্যেই সবকিছু। দাম্পত্যজীবনে সুখী হতে আগে শোধরাতে হবে নিজেকে। তাহলে জীবনসঙ্গীকে শুধরে দেওয়ার অধিকার মেলে। একটু ধৈর্য আর ভালোবাসার মিশেলে দুই তরফের এই দুই অধিকারের সুতোয় সেলাই হোক সুখের নকশিকাঁথা।
মেহেদী হাসান
সোর্স – প্রথম আলো।
Leave a Reply