ডা· জেসমিন আহমদ
সহকারী অধ্যাপক
চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র ইনসুলিন হরমোনের অভাবজনিত একটি রোগ। এই রোগে দেহের যেসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আক্রান্ত হয়, চোখ তার একটি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এপিডেমিওলজিক স্টাডিতে দেখা গেছে, শুধু ডায়াবেটিসের জন্য রেটিনা আক্রান্ত হওয়ার কারণে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছে। এটা অবশ্য নির্ভর করে রোগী কত দিন ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তার ওপর।
ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সময় যত বেশি যাবে, চোখ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ততই বাড়বে। চোখের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রেটিনা। এটা একটা সংবেদনশীল পর্দা, যা চক্ষুগোলকের ভেতরের দিকে থাকে এবং যার ওপর আমরা যা দেখি তার ছবি প্রতিফলিত হয়। এরপর তা বিভিন্ন নিউরো কেমিক্যাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং আমরা আমাদের চারপাশের ছবি দেখি। অনেকে ভাবে, ছানি অথবা অস্বচ্ছ লেন্সের জন্যই শুধু আমাদের দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হয়। এ ধারণা ঠিক নয়। স্বচ্ছ লেন্স আলোকে রেটিনার ওপর প্রতিফলিত করতে সাহায্য করে মাত্র। রেটিনা মূল সংবেদনশীল স্মায়ুপর্দা, যা প্রতিফলিত ছবিটিকে প্রক্রিয়াজাত করে দৃশ্যমান করে। তাই কারও রেটিনা যখন আক্রান্ত হয়, তখন স্বচ্ছ লেন্স থাকার পরও অথবা অস্বচ্ছ লেন্স (ছানি) সরিয়ে স্বচ্ছ কৃত্রিম লেন্স (আইওএল) প্রতিস্থাপনের পরও ওই ব্যক্তি দেখতে পায় না।
ডায়াবেটিসে রেটিনা যেভাবে আক্রান্ত হয়
ডায়াবেটিসে রেটিনায় সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে আসে। এতে একরকম রক্তশূন্যতা অথবা অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়।
ফলে কেন্দ্রীয় রেটিনায় পানি ও তেলজাতীয় পদার্থ জমে ফুলে যায়, অথবা রেটিনায় অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য রেটিনার বিভিন্ন স্থানে নতুন রক্তনালির সৃষ্টি হয়। এসব রক্তনালি স্বাভাবিক রক্তনালির মতো পরিপক্ব হয় না। এই নতুন অপরিপক্ব রক্তনালি খুব সহজেই ভঙ্গুর হয়। এতে চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় এবং এর ফলে দৃষ্টিশক্তি একেবারেই চলে যায়।
ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধের উপায়
এসব সমস্যা প্রতিরোধ অথবা প্রতিকারের জন্য বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। গবেষণার ফলে কিছু কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতিরও উদ্ভব হয়েছে, যাতে কর্মক্ষম দৃষ্টিকে দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায়, যদিও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি একেবারে ভালো হয় না।
চিকিৎসা
— ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করা।
— নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা, যাতে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়ে ও সহজে চিকিৎসা করা যায়।
— বিভিন্ন লেজার থেরাপি, যা আক্রমণের ধরন অনুযায়ী রেটিনায় প্রয়োগ করা হয়।
— সম্প্রতি কিছু ইনজেকশন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা চোখের ভেতর দিলে এসব সমস্যা সাময়িকভাবে প্রতিরোধ করা যায়।
চিকিৎসার ফল ভালো
— যেটুকু দৃষ্টি চলে গেছে, তার কিছুটা ফিরে আসতে পারে।
— প্রতিনিয়ত রেটিনা আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ অথবা ধীর হবে।
— দৃষ্টি হারানোর গতি মন্থর হবে, যাতে কর্মক্ষম দৃষ্টি অনেক দিন পর্যন্ত ধরে রাখা যায়।
— পরবর্তী জটিলতা দেখা দেবে না।
— স্থায়ী অন্ধত্ব প্রতিরোধ হবে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে বলা হয়, চোখ অন্ধকারী রোগ বা ব্লাইন্ডিং ডিজিস। সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ কর্মক্ষম দৃষ্টিকে অনেক দীর্ঘায়িত করতে পারে এবং পরবর্তী জটিলতা থেকে মুক্ত করতে পারে। অবহেলা, অসচেতনতা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিকে আরও জটিল করে এমন অবস্থায় নিয়ে যায়, যা আর চিকিৎসাযোগ্য থাকে না। ফলে স্থায়ী অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। তাই এক্ষেত্রে ডায়াবেটিক রোগীর সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৩, ২০০৮
Leave a Reply