অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
চিকিৎসার চর্চা, অনেকেই বলতে ভালোবাসেন, যত না বিপণন, তার চেয়ে বেশি হলো শিল্প। তবু রোগীর উপসর্গ যখন বইয়ের লেখার সঙ্গে না মেলে, তখন হয়তো চিকিৎসার পুনর্বিবেচনা করতে হয়, নয় তো সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে অনুমান করতে হয়।
এভাবেই হয়তো আগামী বছরগুলোয় হৃদরোগ, ক্যান্সার ও স্থূলতার মতো সমস্যা মোকাবিলায় চিকিৎসকেরা নতুন নতুন পথের সন্ধান পাবেন।
আমাদের তরুণ বয়সে এ অঞ্চলে যে কিংবদন্তি-চিকিৎসকদের কথা শুনেছি এবং অনেকের দেখাও মিলেছে, যেমন কলকাতার ডা· বিধানচন্দ্র রায়, ঢাকার ডা· নন্দী, সিলেটের ডা· হীরেন চৌধুরী-এমন চিকিৎসক যেমন আজকাল পাই না, তেমনি এ কথাও ঠিক, চিকিৎসা অনেক জটিল আর রোগও এখন অনেক বেশি, ধরন তো বটেই।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি বলি, ১৯০০ সাল থেকে, একটি ব্যতিক্রম বাদে (১৯১৮ সাল, যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা-মহামারিতে অনেক লোক মারা গিয়েছিল) হৃদরোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঘাতক-রোগ হিসেবে ঈর্ষণীয় সম্মান পেয়ে এসেছে। এখন হৃদরোগ পৃথিবীর প্রধান ঘাতক-রোগ। এ রোগে প্রতিবছর ১৮ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে। নি্ন ও মধ্য আয়ের দেশেও এ রোগ ক্রমেই বাড়ছে।
তখন দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল, কোলেস্টেরল মান, বিশেষ করে ‘মন্দ কোলেস্টেরল’ লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (এলডিএল) হ্রাস করা হলো রোগকে ঠেকানোর প্রথম উপায়। মাংসের চর্বি, মাখন দেওয়া মিষ্টি, যা রসনার জন্য স্বাদু, এগুলো হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
এখন বিজ্ঞানীরা তাঁদের নজর ফেরাচ্ছেন অন্যদিকে, এলডিএলের হিতকর সঙ্গী এইচডিএলের (হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) দিকে। কারণ, এমন সব তথ্যপ্রমাণ আজকাল পাওয়া যাচ্ছে যে এইচডিএল রক্তনালির দেয়াল থেকে জমা চর্বিকেই শুধু পরিষ্কার করে না, মেদপুঞ্জের আয়তনও সংকুচিত করতে পারে।
তাই চিকিৎসকেরা এখন রোগীদের বলছেন জীবন যাপনে সহজ কিছু পরিবর্তন আনতে বেশি বেশি ব্যায়াম করতে, ওমেগা-৩ মেদ-অল গ্রহণ করতে, যা রয়েছে গভীর পানির মাছে-যেমন স্যালমন ও টুনা মাছ। কারণ, এসব কাজ করলে যকৃৎ থেকে বেশি এইচডিএল কোলেস্টেরল বেরিয়ে আসে।
চিকিৎসকেরা এখন শক্তিশালী স্ট্যাটিন ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দিতে অনেক সাহসী হয়েছেন, এসব ওষুধের কাজ মূলত এলডিএল কোলেস্টেরল হ্রাস করা হলেও এটি দুটি কাজ করে; সেই সঙ্গে এইচডিএলের মানকেও ১০ থেকে ১৫ শতাংশের ওপরে তোলে।
এতে যথেষ্ট কাজ না হলে এইচডিএল-উজ্জীবক বড়ি তো রয়েছেঃ আসছে ফাইজার কোম্পানির ‘টর্সেট্রাপির’। স্ট্যাটিনের সঙ্গে এই বড়ি যোগ করে এবং তা প্রয়োগ করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, এফডিএর অনুমোদন হয়তো মিলে যাবে বছর দুয়েকের মধ্যে।
জন হপকিনস হাসপাতালের প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর ডা· রগার ব্লুমেনথাল বলেন, এইচডিএলের প্রতি এই নতুন দৃষ্টিপাতকে লক্ষ্য করে হৃৎপরিচর্যার ভবিষ্যতের দিকে নজর দেওয়া হলো নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গি।
ওজন হ্রাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁদের চিন্তাভাবনার মধ্যে অদল-বদল হলো। বছর বছর ধরে এমন ধারণা হয়েছিল যে শরীরের বাড়তি ওজন কত বিপজ্জনক হতে পারে, এর শ্রেষ্ঠ পরিমাপ হলো ‘বডি মাস’ ইনডেক্স বা বিএমআই।
দেহের উচ্চতা ও ওজনের সমন্বয়ে তৈরি এই ফর্মুলা হলো বিএমআই। বিএমআই উঁচু মানের হলে বোঝা গেল দেহের উচ্চতা অনুযায়ী শরীরে বডি মাস বেশি বহন করা হচ্ছে, তাই শরীর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোকের মতো রোগের বড় ঝুঁকিতে পড়ল।
কিন্তু সমস্যা হলো, চিকিৎসকেরা দ্রুত বুঝতে পারলেন যে দেহের ভর বা বডি মাস বলতে কেবল বাড়তি মেদই বোঝাচ্ছে না, পেশিও এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
তাই দেহে ফিটনেসের কমতি নেই অথচ শরীরে ঘন পেশি, এদেরও ধরা হচ্ছে ভারী ওজনের আর তাই অস্বাস্থ্যের অধিকারী, কিন্তু তা তো ঠিক নয়।
সে জন্য কিউবেকের লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা· জিন-পেরে ডেসপ্রেস দেহের স্বাস্থ্য নিরূপণে নতুন একটি পরিমাপ নিয়ে এলেন ‘কোমরের মাপ’।
সাম্প্রতিক অনেক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, ‘বড় কোমরের মাপ’ মেটাবলিক সিনড্রমের একটি ভালো সূচক। মেটাবলিক সিনড্রম হলো অনেক উপসর্গের সমষ্টি, যা থেকে পরে হতে পারে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ। ড্রেপ্রেস একে বলছেন একটি ‘প্রধান লক্ষণ’।
তাঁর বক্তব্য হলোঃ এই সহজ-সরল পরিমাপটি চিকিৎসকদের রোগীর দৈহিক চেকআপের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। রক্তের কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ মেপে দেখা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কোমরের মাপ নিরূপণ করা ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। এত সহজ-সরল পরিমাপ রোগীর জন্য ঘুম থেকে জাগানিয়া আহ্বানের মতো; বড় কোমরের মাপ যাদের, তারা শরীর থেকে দু-চার পাউন্ড ওজন কমালে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারে।
কোমরের মাপের সঙ্গে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগের সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ দেশে মৌলিক কাজ করেছেন স্মেহভাজন অধ্যাপক আবু সায়ীদ, ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজের লোকসমাজ মেডিসিনের অধ্যাপক ও খ্যাতনামা এপিডেমিওলজিস্ট। এসব গবেষণা নিয়ে পরে লিখব।
এ ধরনের আগাম সতর্কসংকেত আরও নতুন করে দেখছেন ক্যান্সার-বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের সাম্প্রতিক কৌশলের ক্ষেত্রে একটি বিষয় দৃষ্টি কেড়েছে, তা হলো কিছু ক্যান্সারের জেন্ডার প্রবণতা। যেসব মহিলা ধূমপান করে, তাদের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা পুরুষ-ধূমপায়ীদের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
সেল থেরাপিউটিক্সের বিজ্ঞানীরা বি্নয়ের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে এর কারণ হলো স্ত্রী-হরমোন ইস্ট্রোজেন। ঋতুমতী নারীদের রক্তে হরমোন ইস্ট্রোজেন বেশি এবং এই হরমোনের উপস্থিতিতে ফুসফুসের কোষগুলো সিগারেটের ধোঁয়ার কার্মিনোজেনের মুখোমুখি হয় বেশি। এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার নতুন অধ্যায় হয়তো উ্নোচিত হবে একদিন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৩, ২০০৮
Leave a Reply