অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
মে মাসে যে বিশ্ব হাসি দিবস পালিত হলো, এ নিয়ে অনেকের মধ্যে তেমন উৎসাহ নেই। তবে এটি ঠিক, হাসতে শেখা উচিত। হাসার সম্ভাব্য কারণ না থাকলেও হাসা ভালো। স্বাস্থ্যের জন্য। যাঁদের বয়স পঁচিশের ওপরে, তাঁরা কবে যে অট্টহাসি হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছিলেন একসময়, তা কি স্মরণে আছে? যদি মনে না থাকে তাহলে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, বি্নিত হওয়ারও কিছু নেই। বলেন সার্টিফায়েড হাসি থেরাপিস্ট সেরিনা ভ্যান রেনসবার্গ। তাঁর পর্যবেক্ষণ এখানেই শেষ নয়।
পূর্ণবয়স্ক লোক দিনে গড়ে হাসেন ১৫ বার সম্ভবত। তবে শিশুরা দিনে হাসে ৪০০ বারেরও বেশি, অকারণেই। টিনএজারদের খিলখিল হাসি তো আমরা শুনেই থাকি! বয়স্করা এতে বিরক্ত হন। হবেনই তো। কারণ তাঁরা জোরে হাসার ক্ষমতাই যে হারিয়ে বসে আছেন! তবু বলেন রেনসবার্গ, ‘হাসার ক্ষমতা-এখানে যে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়, তা হলো বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই হাসা। বড়রা আবার শিখবেন শিশুসুলভ চপল হাসি-স্বাস্থ্যকুশলের জন্য। মানুষ জন্মেছে হাসার জন্যই। কিন্তু জীবনপথে চলতে চলতে সে ক্ষমতা অনেকটাই যায় হারিয়ে। এমন কথা অনেকেই বলেন, হাসি বন্ধ করো, বাচ্চাদের মতো কোরো না। অথচ আমাদের বোঝা উচিত, হাসতে শেখা উচিত অকারণেই।’
হাসির অনেক সুফল
শ্বাস-প্রশ্বাস গভীর হয়। ফলে বেশি বেশি অক্সিজেন ঢোকে শরীরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এতে মুখ-হরমোন ‘এনডোফিন’ উৎসারিত হয়; মানুষ হয় হালকা, ভারশূন্য। আরও আছে। হাসলে মগজের ছন্দ নেমে আসে আলফা ছন্দে, বাড়ে আত্মমর্যাদাবোধ, শক্তিশালী হয় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা। প্রকৃতিজাত ঘাতক কোষের (কেকেসি) সংখ্যা বাড়ে, বাড়ে দেহপ্রতিরোধক অ্যান্টিবডি। আর হাসি মানুষকে একটি শঙ্কাহীন, অরাজনৈতিক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পতাকাতলে একত্র করে।
ভ্যান রেনসবার্গ নামে সেই গবেষক মহিলার মতে, আকর্ণবিস্তৃত হাসি হলো ভেতরের ও বাইরের শান্তির দ্বারপথ। হাসি তাই হাস্যকর ব্যাপার নয় মোটেই, হাসতে পারার ক্ষমতার জন্য চেষ্টা চাই সবারই।
১৯৯৫ সালে মুম্বাইয়ের চিকিৎসক মদন কাটাবিয়া তাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দ্য স্কুল অব ইয়োগা লাফার’। এ বিদ্যালয়ের মূল কথা হলো ‘অকারণে হাসা’। এটি এখন বিশ্বে আন্দোলনে পর্যবসিত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইয়োগা ব্রিদিং কৌশল ও ব্যায়াম। এতে বেশি বেশি অক্সিজেন ঢোকে শরীরে। ‘উদ্দেশ্য ছাড়াই হাসা’, ভ্যান রেনসবার্গ বলেন, ‘এর অর্থ হলো কেউ হয়তো স্বতঃস্কূর্তভাবে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল না, তবে জোর করে হলেও হাসিতে উচ্ছ্বসিত হওয়া ভালো। কারণ স্বতঃস্কূর্ত হাসি ও জোর করে জোরে হাসার মধ্যে যে তফাৎ, মগজ তা ধরতে পারে না। শরীর তাই সাড়া দেয় দুটোতেই একইভাবে। এ ছাড়া হাসির একটি ভালো চর্চাও হলো।’
হাসির অন্তর্নিহিত সত্য তো তাই নেতিবাচক চিন্তা দূর হওয়া, দৈহিক স্বাস্থ্য ভালো হওয়া, আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটা।হাসির একটি সেশন কেমন হতে পারে? বৃত্তাকারে লোকজন দাঁড়াল এবং তালে তালে হাততালি দিল। এরপর জোড়ায় জোড়ায় শরীর দোলাতে দোলাতে বলল, ‘হো হো হা হা হা।’ এরপর উচ্চারণ করল, ‘ভালো, ভালো। বেশ, বেশ।’ বারবার। আর জানার আগেই সবাই হাসছে-জোর করে হোক আর স্বতঃস্কূর্ত হোক।
কত রকম হাসি আছে? সুখের হাসি, অট্টহাসি, কাষ্ঠহাসি, মৃদু হাসি, মুচকি হাসি, পানমৌরি হাসি···। এর পরের সেশনে ‘ইয়োগা হাসি’। ইয়োগা তোশকে চিৎ হয়ে শুয়ে জোরে হাসুন, অবিরাম ২০ মিনিট। যখনই হাসছেন, সে হাসি ছড়িয়ে পড়ছে অন্যজনে। অন্যরাও হাসছে···।
এ রকম একটা সেশন করে একজন এক ঘণ্টার মধ্যে চাপমুক্ত হতে পারেন, প্রাণশক্তিতে হতে পারেন ভরপুর। হাস্য-থেরাপি গবেষক অধ্যাপক রবার্ট প্রোভাইন বলেন, যেকোনো মজার জিনিস দেখলে মানুষ হাসে, তা ২০ শতাংশ। মানুষ যখন একা না থেকে দলে থাকে, তখন হাসির প্রবণতা বাড়ে ৩০ গুণ।
মেয়েরা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি হাসে, সহজে হাসে। সামাজিক পরিবেশে মানুষের হাসি বেশি হয়। মানুষ অন্যের সঙ্গে আলাপের সময় বেশি হাসে। বিখ্যাত সাংবাদিক নরমান কাজিনস এব উকি বলেন, ‘হাসি মানুষকে দেয় শরীর ও মন ভালো লাগার অনুভূতি। রোগ নিরাময় বা আরোগ্যের কোনো পর্যায়ে হাস্যরসকে যোগ দেওয়ালে অনেক লাভ হয়।
আমাদের শরীর, মন ও আত্মার জন্য প্রয়োজন ভালো একটি ভরপেট হাসি। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক বিশ্বের বাধানিষেধে আমাদের ভেতরের সদাহাস্য, সুন্দর শিশুটি চুপ হয়ে আছে।’ দেখা গেছে, যে শিশু বিপর্যয়ের পরিবেশে; মানসিক, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ও হীনম্মন্যের পরিবেশে থাকে, সে কখনো ইতিবাচক কৌতুক, হাস্যরস, আনন্দময় জীবনকে প্রশংসা করতে শেখে না। কিন্তু যে শিশু সুখী ও আনন্দময় ঘরে বড় হয়, যেখানে হাসির নিত্য আসা-যাওয়া; সেই শিশু বড় হলে হবে কৌতুকপ্রিয় ও আনন্দময়।
হাসি বিষণ্নতাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কত বিষণ্ন রোগী হাসির তোড়ে ভালো হয়েছে! দেখেছেন ভ্যান রেনসবার্গ। আমরা হাসব চাপের পরিবেশেও। জীবনকে অত গুরুতরভাবে নেওয়া কেন? হালকাভাবেও তো নিতে পারি মাঝেমধ্যে!
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০০৮
Leave a Reply