ডা· এম শহীদুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
এসপিআরসি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
অস্টিওপোরোসিস হাড়ের রোগ। হাড়ের ঘনত্ব নির্দিষ্ট মাত্রায় কমে যাওয়াকে অস্টিওপোরোসিস বলে। হাড়ের ভেতর ঘনত্ব বাড়া-কমা একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত হাড়ের ঘনত্ব বেড়ে একটি পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর ক্ষয় ও গঠনপ্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে থাকে এবং ক্ষয়ের মাত্রাটা একটু একটু করে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে মেয়েদের মেনোপজ বা ঋতু বন্ধের পর শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমার সঙ্গে হাড়ের ক্ষয়ের মাত্রা বেড়ে যায়।
পুরুষদের হরমোন টেস্টোস্টেরন ৭০ বছর বয়সের আগে সাধারণত কমে না এবং তখন থেকেই হাড়ের ক্ষয় ত্বরান্বিত হতে থাকে। নির্দিষ্ট বয়সে হাড়ের ক্ষয় একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কয়েকটি বিশেষ রোগে ও বিশেষ ওষুধ দীর্ঘ সময় ধরে সেবন করলে এই ক্ষয়প্রক্রিয়া বেড়ে যেতে পারে এবং হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে।
মেরুদণ্ড ও ঊরুর ওপরের অংশ অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশি নরম হয়ে থাকে। হরমোন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা খুবই কম। যারা নিয়মিত হাঁটে, ব্যায়াম করে এবং কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্ত, তাদের হাড়ের ক্ষয় খুব কম হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ সেবন করলে, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি ধরনের খাবার কম খেলে হাড়ের ঘনত্ব কমতে পারে। স্বাভাবিক খাবার, বিশেষ করে শাকসবজিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি থাকে, যা শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশু, যারা প্রচণ্ড রকমের অপুষ্টিতে ভোগে, তাদের মধ্যে রিকেট, অস্টিওপেনিয়া ও অস্টিওম্যালাসিয়া দেখা দিতে পারে। স্বাস্থ্য-সচেতনতা বাড়ায় এ ধরনের রোগের সংখ্যা অবশ্য এখন অনেক কমে গেছে। সক্রিয় ভিটামিন-ডি হাড়ের গঠনে সাহায্য করে থাকে। ভিটমিন-ডি রোদের আলোতে ত্বকের নিচে তৈরি হয় এবং লিভার ও কিডনিতে সক্রিয় হয়। তাই লিভার ও কিডনির বিশেষ দু-একটি রোগে সক্রিয় ভিটমিন-ডির অভাব হয়ে অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।
আসলে বয়স্ক নারীরা ছাড়া অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম। স্বাভাবিক অর্থে এদের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া চিকিৎসকেরা যাদের অস্টিওপোরোসিস হতে পারে বলে মনে করবেন, তাদের বোন মিনারেল ডেনসিটি (বিএমডি) বা হাড়ের ঘনত্ব মাপার বিশেষ পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন, যা এখন ৫০০ টাকায়ই করিয়ে নেওয়া সম্ভব।
ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির প্রয়োজন সম্পর্কে মানুষ সচেতন নয় বলে এবং অনেকের মধ্যে এর অপরিহার্যতা সম্পর্কে সংস্কার থাকায় শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই, বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোতে ক্যালসিয়ামের ব্যবহার বা অপব্যবহার বাড়ছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্যালসিয়াম-বাণিজ্য (!) ব্যাপক প্রসার লাভ করছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রস্তুতকারক ক্যালসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি কম্বিনেশন তৈরি করলেও অনেক আমদানিকারকই এসব ফুডগ্রেনের নামে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাজারজাত করছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী নিজেই বলে তাকে একটা ক্যালসিয়াম লিখে দিতে বা নিজেই দোকান থেকে
ক্যালসিয়াম কিনে সেবন করে। ক্যালসিয়াম খেলে রোগীরা ভালো থাকে বলে জানিয়েছে।
কিন্তু প্রয়োজন সম্পর্কে কেউই সচেতন নয়। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির বাণিজ্য এতটাই প্রসার লাভ করছে যে বিদেশি কোম্পানির মোড়ক লাগিয়ে দেশীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা যে কম মূল্যে ক্যালসিয়াম বাজারজাত করছে না, তা কি আমাদের ওষুধ প্রশাসন পর্যবেক্ষণ করছে?
অস্টিওপোরোসিস রোগে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে পারে না। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। প্রতিরোধের জন্যও রয়েছে অনেক ভালো ওষুধ। ঋতু বন্ধের পর নারীরা ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রতিস্থাপন বা এর এনালগ টিবোলন অথবা র্যালক্সিফেন ইস্ট্রোজেন মডুলেটর ব্যবহার করতে পারেন।
অস্টিওপোরোসিসের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য সারা বিশ্বেই এখন বিসফসফোনেট গ্রুপের ওষুধ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর ফলাফলও চমৎকার।
কাজেই যেকোনো রোগে যেকোনো বয়সে যখন-তখন ক্যালসিয়াম খাওয়ার প্রয়োজন নেই। চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে অবশ্যই তা সেবনের পরামর্শ দেবেন। অস্টিওপোরোসিস যাদের নির্ণীত হয়েছে বা হওয়ার ঝুঁকি আছে, তাদের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেওয়াটা ভালো। ওষুধ বা রোগের কারণে অস্টিওপোরোসিস হয়ে থাকলে সেই কারণটি নির্ণয় ও নির্মূল করতেই হবে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০০৮
Leave a Reply