প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম কিউ কে তালুকদারের উদ্যোগে সাভারের আশুলিয়ায় গড়ে উঠেছে আধুনিক মা ও শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা কেন্দ্র-‘নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ, মাতুয়াইলের শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সফল প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক তালুকদার নারী ও শিশুস্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই সেবাকেন্দ্র। কেন্দ্রটির সেবাদানের কর্মকাণ্ডের ওপর আজকের ‘স্বাস্থ্যকুশল’-এর মূল প্রতিবেদন সরেজমিন ঘুরে এসে লিখেছেন আরাফাত সিদ্দিকী
সোনিয়া বেগম একজন গৃহিণী। স্বামী নূরে আলম, কাজ করেন স্থানীয় একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। থাকেন সাভারের প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই কারখানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন নূরে আলম। স্ত্রীকে রেখে যান মায়ের হেফাজতে। সোনিয়া বেগমের শাশুড়ি সারাক্ষণ লক্ষ রাখেন সাড়ে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূর ওপর।
একদিন হঠাৎ প্রসববেদনা শুরু হয় সোনিয়া বেগমের। শাশুড়ির হিসাবমতো, সময়ের অনেক আগেই উঠেছে সোনিয়া বেগমের ব্যথা। খবর পেয়ে হন্তদন্ত নূরে আলম যখন বাড়ি পৌঁছান, তখন সোনিয়া বেগমের অবস্থা প্রায় মরণাপন্ন। দেরি না করে রিকশাভ্যানে চেপেই স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হন নূরে আলম। গন্তব্য প্রায় তিন ঘণ্টার পথ-সাভার থানা সদর। পথিমধ্যে সোনিয়া বেগমের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। প্রসবব্যথায় তখন প্রায় অচেতন তিনি।
অবস্থা দেখে রিকশাভ্যানের চালক পরামর্শ দিলেন, কাছেই ব্যারণ সরকার মার্কেটের পাশে নতুন একটি হাসপাতাল হয়েছে। নাম ‘নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। সেখানে গেলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
তখন দিগ্বিদিক চিন্তা করার মতো সময় নেই নূরে আলমের। সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু পথেই পড়বে, তাই আগে ওই হাসপাতালেই যাবেন। আর তাঁর এই সিদ্ধান্তই সেদিন কষ্ট কমিয়ে দেয় সোনিয়া বেগমের। নূরে আলম হন ফুটফুটে এক সন্তানের জনক।
২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা
ওপরের ঘটনাটি আশুলিয়ায় ঢাকা ইপিজেড মহাসড়কে অবস্থিত নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের (সিডব্লিউসিএইচ) এক রোগীর। এ হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে জানতে চাইলে সোনিয়া বেগমের শাশুড়ি বলেন, জীবনে তিনি অনেক হাসপাতাল দেখেছেন, কিন্তু গরিবের জন্য এত ভালো সেবাদানকারী হাসপাতাল দেখছেন এ-ই প্রথম, যেখানে দরিদ্র রোগীদের সেবার মানের কোনো ঘাটতি হয় না। হাসপাতালটির মূল অর্থের জোগান দেয় ছয় সদস্যের সিডব্লিউসিএইচ ট্রাস্টি বোর্ড।
এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাতুয়াইল শিশু হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ডা· এম কিউ কে তালুকদার।
সোনিয়া বেগমের মতো এমন আরও অনেক রোগীকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা থাকে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা, সারা বছর। তবে জরুরি বিভাগ ছাড়া বহির্বিভাগে সাধারণ রোগী দেখার সময় সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত।
আন্তরিকতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে সেবা দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে মানুষের হাসপাতালভীতি কমাতে। তাই ইতিমধ্যে সাভার বাণিজ্যিক এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিডব্লিউসিএইচ।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিশ্চিত করে সেবার মান
নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কনসালট্যান্ট শিশু বিশেষজ্ঞ এবং গবেষণা বিভাগের সমন্বয়কারী ডা· খুরশিদ তালুকদার রনি জানান, চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করতে এখানে নেওয়া হয় ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগ।
এর মধ্যে রয়েছে জনমত জরিপ, পর্যবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি। এই হাসপাতালের রোগী দেখার পুরো ব্যাপারটি সম্পন্ন হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে।
হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে নির্দিষ্ট ডেটা সেন্টারের আওতায় একটি করে কম্পিউটার। শুধু এই হাসপাতালের জন্য নির্মিত একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয় রোগী দেখার কাজে।
সফটওয়্যারটির মাধ্যমে হাসপাতালের পরিচালনাকারীরা জানতে পারেন-কোন চিকিৎসক কতক্ষণ একজন রোগী দেখলেন, রোগীর রোগ নির্ণয়ে কোনো ভুল হলো কি না, অথবা কী কী পরামর্শ রোগীকে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে ডেটা সেন্টারে সংরক্ষিত হয়ে যায় রোগীর যাবতীয় তথ্য। পরবর্তী সময় শুধু নাম অথবা নির্দিষ্ট কোড নম্বর বললেই কর্তব্যরত চিকিৎসকের সামনে চলে আসে সংরক্ষিত তথ্যগুলো। এ পদ্ধতিতে রোগীর ভোগান্তি যেমন কমে, তেমনি নিশ্চিত হয় সেবার মান।
শ্রমজীবী মানুষের জন্যই যে হাসপাতাল
ডা· রনি জানান, এই হাসপাতালের মোট জমির পরিমাণ ৩ দশমিক ৭৬ একর। এর চারপাশ ঘিরে আছে বিভিন্ন কলকারখানা। এই জায়গার প্রকৃত মালিক অ্যাপোলো হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিডব্লিউসিএইচ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য খন্দকার মনিরউদ্দিন।
প্রথমে এই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল একটি পোশাক কারখানা। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্যসেবার কথা চিন্তা করেই তিনি হাসপাতালের নামে এই জায়গাটি দান করেছেন।
ডা· রনি বললেন, ‘আমাদের দেশে প্রতিবছর গর্ভধারণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ১৬ হাজার নারী। অথচ গর্ভধারণ কোনো রোগ নয়। অন্যদিকে নবজাতক মৃত্যুর হার বছরে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার। আমাদের একটু সচেতনতাই পারে মৃত্যুর এই হার কমাতে। তাই সিডব্লিউসিএইচ স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি কাজ করছে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য গর্ভধারণজনিত কারণে নারীমৃত্যুর হার কমানো। সে লক্ষ্যেই এই হাসপাতাল এগিয়ে যাচ্ছে তিনটি ধাপে। সেগুলো হলো-স্বাস্থ্যসেবা, গবেষণা ও জরিপ এবং প্রশিক্ষণ।
শহরতলির আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র
হাসপাতালের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম জানালেন, এই হাসপাতালে রয়েছে প্রায় ১৩টি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।
এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রোপচার কেন্দ্রসহ স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগ, চক্ষু বিভাগ, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, জরুরি বিভাগ, মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ, বিভিন্ন ধরনের সার্জারি বিভাগ প্রভৃতি।
সেই সঙ্গে সম্প্রতি শুরু হয়েছে দন্ত বিভাগ। এ ছাড়া এই হাসপাতালে রয়েছে ১১টি চিকিৎসাসহায়ক বিভাগ।
এর মধ্যে রয়েছে মেডিসিন ল্যাবরেটরি, ফিজিও ও অকুপেশনাল থেরাপি, অডিওলজি, স্পিচ থেরাপি, পুষ্টি বিভাগ প্রভৃতি। নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। এদের বেশির ভাগই পোশাকশিল্পের কর্মী।
বহির্বিভাগে প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হয় প্রথমবার মাত্র ৩০ টাকা আর পরবর্তী প্রতিবার ২০ টাকা।
এ ছাড়া নারী ও শিশুদের বিভিন্ন টিকাদানের ক্ষেত্রে খরচ পড়ে প্রথমবার ২০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতিবার ১০ টাকা।
মূলত পোশাকশিল্পের শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য এই হাসপাতাল নির্মিত হলেও এখানে চিকিৎসা নিতে পারে যে-কেউ। বিশেষত নারী ও শিশু হাসপাতাল হলেও পুরুষেরা এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়। এই হাসপাতালে কর্মী আছেন ১০৫ জন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ৩০ জন।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণ
সাধারণ চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয় বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ কার্যক্রম। ইতিমধ্যে এখানকার গবেষণাকর্মীরা সম্পন্ন করেছেন চারটি গবেষণা। কার্যক্রম চলছে আরও পাঁচটির।
ডা· খুরশিদ তালুকদার রনি জানান, এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়েছে একটি নার্সিং স্কুল স্থাপনের জন্য। বর্তমানে শুধু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করলেও এর মূল লক্ষ্য নারী ও শিশুর সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন।
তাই প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণা ও সামাজিক সচেতনতা।
ভবিষ্যতে এসব গবেষণালব্ধ ফলাফল সরকারের কাছে উপস্থাপন করে বিভিন্ন সুপারিশ করবে হাসপাতালটি। সারা দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতন করতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণেও সহায়তা করবে প্রতিষ্ঠানটি।
তাই আধুনিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনেরও উদ্যোগ নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে দুস্থদের সার্বক্ষণিক সেবার মান নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হবে জরুরি বিভাগের কর্মীদের জন্য আবাসিক কমপ্লেক্স।
আরও কিছু লক্ষ্য
২০১৫ সাল নাগাদ এই হাসপাতাল প্রতিদিন সেবা দেবে প্রায় এক হাজার ৫০০ জন রোগীকে। যার মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো রোগী থাকবে প্রায় ৫০ জন। সে লক্ষ্যে এখানে নির্মাণ হতে যাচ্ছে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। এর জন্য প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের অর্থ। ইতিমধ্যে এই হাসপাতালে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
এর পুরোটা দিয়েছেন সমাজসচেতন ব্যক্তিরা। বৃহৎ এই হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গরূপ দিতে প্রয়োজন আরও অনেক অর্থের। সিডব্লিউসিএইচের পরিচালকেরা জানান, যেকোনো মহৎ ব্যক্তিই পারেন এই বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে। তাঁদের দানের অর্থের বিনিময়ে বেঁচে যেতে পারে সোনিয়া বেগমের মতো অনেক প্রাণ।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৯, ২০০৮
Md:Shohedullah
পড়ে মনে হয় ভাল, যাওয়ার পর সেবা ভাল পাওয়া যায় না। অনেক হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে দেখলাম দুর্নীতি আর অনিয়ম।
রাজ বিল্লাল
গরীবদের কি কখনো ছাড় দিছেন??