অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
বাড়ছে পড়াশোনা, বইয়ের চাপ। একনাগাড়ে পড়া, বিরতি কম। গণমাধ্যম, সমাজ-সবকিছু থেকেই মা-বাবারা জানছেন যে একেবারে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের খুব দক্ষ করে তুলতে হবে, লেখাপড়ায় তুখোড় করে তুলতে হবে। প্রতিযোগিতার বিশ্বে টিকে থাকার জন্য। তাই মা-বাবারা শিশুদের নানা কাজে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, কিনে দিচ্ছেন শিক্ষামূলক খেলনা, ভিডিও, বিভিন্ন গ্যাজেট। কেবল খেললে শিশুর কিছু হবে না-এমন ভয় ঢুকে যাচ্ছে তাদের মনে।
আজকাল কলেজে ভর্তি হওয়া কঠিন ব্যাপার, তাই মা-বাবারা শৈশব থেকেই বাচ্চাদের লেখাপড়ায় কারিকুলাম-বহির্ভূত নানা কাজে দক্ষ ও চৌকস করে তুলতে ব্যস্ত। খেলতে দেওয়ার মতো কাজে সময় নষ্ট করতে রাজি নন তাঁরা। স্কুল পাস করে ভালো কলেজে ঢোকার জন্য আরও পরিশ্রম।
কঠোর পড়াশোনার কর্মসূচি, কোচিং, ভর্তি পরীক্ষার জন্য মক টেস্ট-ফুরসত নেই। সময় নেই অবসর নেওয়ার, খেলার। আবার খেলার মাঠও নেই। নিরাপদে যে খেলবে এবং বাড়ি ফিরে আসবে, তেমন গ্যারান্টিও নেই।
— খেলা শুধু খেলা নয়, সুন্দর ও নির্মল সময় কাটানোও বটে, সেই সঙ্গে মন ও শরীরেরও কুশল হলো। শিশুরা যে খেলার জন্য সময় পাচ্ছে না, এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স। কারণ-
— শিশুর বিকাশের জন্য খেলা গুরুত্বপূর্ণঃ খেলার মাধ্যমে শিশু আবিষ্কার করে বিশ্ব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল শেখে, নিজের শখ ও খেয়াল চিনতে পারে।
কীভাবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়, সমঝোতা করতে হয়, পরস্পর অংশীদার হতে হয় কোনো কাজের, তাও শেখে।
খেলার মাধ্যমে শিশু শেখে জটিল এ পৃথিবীর পথে কী করে চলতে হয়-প্রস্তুত করে নিজেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য।
— শরীরের জন্য খেলা গুরুত্বপূর্ণঃ যেসব শিশু খেলার সময় পায় না বা খেলার সময় খেলে না, সময় কাটায় টেলিভিশন বা কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে-এদের মধ্যে স্থূল হওয়ার প্রবণতা বেশি।
— মনের স্বাস্থ্যের জন্যও খেলা গুরুত্বপূর্ণঃ জীবনের চাই অবসর, অবকাশ, এত নিয়ম মেনে জীবন চলে না, সে সময় একটু রিলাক্স করতে হয়, চাপমুক্ত হতে হয়। শৈশবে ও তারুণ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, খেলার সময় না থাকা এর একটি কারণ। খেলার পর্যাপ্ত সময় না থাকলে শিশুদের মধ্যে আরও বাড়বে বিষণ্নতা, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ।
— স্কুলে খেলাধুলা বেশ গুরুত্বপূর্ণঃ ছাত্রদের শিক্ষাগত, সামাজিক ও আবেগ-এসবের বিকাশের সহায়তা জোগায় খেলাধুলা।
শেখার নেশাও এতে বাড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, পড়াশোনার ফাঁকে খেলার বিরতি থাকলে শিশুরা শেখে ভালো, স্কুলের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ বাড়ে।
— মা-বাবা এবং পরিবারের জন্যও খেলা গুরুত্বপূর্ণঃ
খেলায় মা-বাবা যোগ দিলে বাচ্চাদের আরও ভালো করে জানতে পারেন তাঁরা, সম্পর্কও হয় দৃঢ়। একসঙ্গে পরিবারের সবাই সময় কাটালে, খেলায়, আনন্দে-শিশুদের লালনপালন, এদের নির্দেশনা শিক্ষা হয় ঠিকমতো, শেখানো যায় মূল্যবোধ। জীবনে সুখী, সফল ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো মনমানসিকতা গড়ে উঠতে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
জীবন থেকে খেলা যেন হারিয়ে না যায়। আমাদের শিশুদের সুখ, স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যতের জন্য এর গুরুত্ব অনেক। আছে পরামর্শ কী করে শিশুকে দেওয়া যাবে অবসর, অলস সময়, নিজের জন্য-
— দেখতে হবে শিশুর জীবনে যেন কিছু সময় থাকে তার নিজের জন্য, অবসরের জন্য। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কার্যসূচির বাঁধনে বাঁধা না পড়ে।
— শিশু যখন কাজকর্মে থাকে, তখন লক্ষ করবেন তার মনে বা শরীরে কী চাপ পড়েছে। মনে দুঃখ বা বিষণ্নতা আছে কি না। ক্ষুধা কমেছে কি না, ঘুম কমেছে কি না, বন্ধুর সঙ্গে বা স্কুলে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এমন হতে পারে যে তার ওপর কাজ বা পড়ার চাপ খুব বেশি, সে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
— শিশুর চরম সাফল্য অর্জনের জন্য যা কিছু পড়ছেন বা শুনছেন, সব বিশ্বাস করতে যাবেন না। আধুনিক কম্পিউটার সফটওয়্যার বা পিয়ানো লেসনের চেয়ে ভালোবাসা, লালনপালন এবং সৃজনশীল কাজ শিশুর জীবনে অনেক বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারে।
— শিশুর সঙ্গে খেলা করুন। যোগ দিন চা-চক্রে। গল্প শোনান তাদের। তার সঙ্গে বসে ছোট ছোট খেলনা নিয়ে একটি দুর্গ গড়ে তুলুন। বাচ্চা খুশি হবে, তার সঙ্গে গড়ে উঠবে দৃঢ় বন্ধন।
— একত্রে সময় কাটান পরিবারের সদস্যদের মতো। কোনো রাতে বসে ছবি দেখুন, নয় তো নাটক দেখুন শিশুর সঙ্গে। অথবা একত্রে হাঁটুন।
— সন্তান যখন কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করবে, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ণয়ে সহায়তা করুন।
— টিভি ও কম্পিউটার বন্ধ করে দিন। শিশু হাঁটুক, ভাবুক, স্বপ্নের ডানায় ভর করে উড়ুক।
— এমন সব খেলনা কিনুন, যা ভাবনাকে উসকে দেয়। ডল, ব্লক, পেইন্ট, ড্রেসআপ পোশাক।
— প্রতিদিন শিশুকে কিছু পড়ে শোনান।
— শিশুর খেলার জন্য নিরাপদ এলাকা খুঁজে দিন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৯, ২০০৮
Leave a Reply