দিহানের (ছদ্মনাম) ইদানীং সবকিছু কেমন যেন লাগছে। সে লামিয়াকে (ছদ্মনাম) ভালোবাসে, অনেক ভালোবাসে। কিন্তু লামিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটাই তাকে অনেক ভাবায়। কেন যেন মনে হয় লামিয়া যেকোনো সময় তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। কেমন সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে লামিয়া বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে আজকাল, দিহানের পছন্দ হচ্ছে না। সিনেমা তো তার সঙ্গেও দেখতে যেতে পারত লামিয়া। লামিয়া রাতের বেলা অনলাইনে থাকছে, যখন দিহান থাকছে না তখনো। লামিয়া তার কথাবার্তাও ইদানীং বোধ হয় শুনছে কম। লামিয়াকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না দিহান। এসব ভেবেই দিহানের মেজাজ খারাপ লাগছে অনেক।
লামিয়াও দিহানকে ভালোবাসে। দিহানও যে তাকে ভালোবাসে, সেটাও সে জানে। কিন্তু এটা কেমন ভালোবাসা? সব সময় দিহানকে তার খুশি করে চলতে হয়। সে কোথায় যাবে, কার সঙ্গে যাবে—সবকিছু দিহানকে এমনভাবে বলতে হয় যেন সে দিহানের অনুমতি নিচ্ছে! দিহান সব সময় তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে বসে থাকে। তার ছবি স্ট্যাটাসে কেউ লাইক দিলেও কেন দিল, তা নিয়ে দিহানের কাছে জবাবদিহি করতে হয় তার। সেদিন তো পাসওয়ার্ডও চাইল দিহান। তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দিহান করছে বাজেবাজে সার্কাজম। লামিয়ার কি ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই তাহলে? তার ছেলেবন্ধু আছে কিছু, দিহান তাদের নিয়ে ঈর্ষায় ভোগে, তাকে অবিশ্বাস করে। এসব নিয়ে লামিয়া চায় দিহানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে, কিন্তু দিহানের তাতেও আপত্তি। আর দিহানকে কিছু বললেই বলে, লামিয়াকে ভালোবাসে বলেই নাকি দিহান এমন করে। এসবই নাকি ভালোবাসা। তার নাকি ভয় হয় লামিয়া তাকে ছেড়ে যায় কি না, এ কথার পর লামিয়াও আর কিছু বলতে পারে না।
আমরা চাই আমাদের প্রতিটি সম্পর্কই টিকে থাকুক। ভয়ে থাকি সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সব চেষ্টাই আমরা করি। আর চেষ্টা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজের অজান্তে হয়ে যাই পজেসিভ। এই আধিপত্য বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার (পজেসিভনেস) সম্পর্কে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল বলেন, ‘সম্পর্কে পজেসিভনেস দুটি বিষয় থেকে আসে। এক হলো, সম্পর্কটা নিয়ে যখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি, তখন আমরা পজেসিভ হয়ে যাই, সম্পর্কের পরিণতি সম্পর্কে শঙ্কাযুক্ত হয়ে সঙ্গীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করি। আর দুই. বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কে পুরুষেরা মাঝে মাঝে পজেসিভ হয়ে যান তাঁদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে। তাঁরা চান নারী সঙ্গীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে।’
হ্যাঁ, আমাদের উদ্দেশ্য, যা কিনা সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা, সেটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা যায়, একসময় আমাদের আচরণে প্রকাশ পায় ঈর্ষা, সঙ্গীর ওপর প্রভাব বিস্তার করার ইচ্ছা, অবিশ্বাস। আমাদের বন্ধুর কিংবা প্রেমিক/প্রেমিকার অন্য সম্পর্কগুলো সহ্য করতে পারি না। মনে হয়, সে বুঝি আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের চেয়ে অন্য সম্পর্কটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে! ঈর্ষা হয়, অবিশ্বাস হয়। শেষমেশ দেখা যায়, সম্পর্কটাই আর টেকে না।
অনেক সময় দেখা যায়, একটা সম্পর্ক খুবই সুন্দর। নিরাপত্তাহীনতার ভয় থাকার কোনো প্রশ্নই নেই। তাও প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা হয়ে যাচ্ছে পজেসিভ। তাদের মধ্যে শুরু হচ্ছে সমস্যা, সম্পর্কে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। আহমেদ হেলাল এ নিয়ে বলেন, ‘সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকার পরও কোনো সম্পর্কে কেউ যদি পজেসিভ হয়ে যান, তাহলে বুঝতে হবে তিনি আত্মবিশ্বাসের সংকটে ভুগছেন। সম্পর্কটা একটা দীর্ঘস্থায়ী রূপ পাবে—এমন বিশ্বাস তাঁর মাঝে এখনো গড়ে ওঠেনি।’
এখন প্রশ্ন হলো, পজেসিভনেস আমাদের মাঝে আসলে কীভাবে তৈরি হয়। কোনো একটা সম্পর্কে জড়ালে নিরাপত্তাহীনতার কারণেই হোক কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণেই হোক, আমরা যে পজেসিভ হয়ে যাচ্ছি, সেটার উৎসটা কোথায়? মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক কিছুই ঠিক করে দেয় আমাদের চারপাশ। পজেসিভনেসের ক্ষেত্রেও একই কথাই খাটে। আহমেদ হেলালের মতে, ‘পজেসিভনেস জিনিসটা একটা অবজারভেশনাল লার্নিং। কেউ যদি দেখে তার আশপাশের কেউ পজেসিভ কিংবা আগে তার ওপর কেউ পজেসিভনেস খাটিয়েছিল, তখন সে পজেসিভ হতে শেখে। এটা পরিবার থেকে শুরু করে স্কুলিংয়ের কারণেও সম্ভব।’
ঈর্ষা, ভয়, সঙ্গীর ওপর অবিশ্বাসসহ আরও অনেক কিছুর উৎপত্তি পজেসিভনেস থেকে। তাই আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত এই ব্যাপারটা কাটিয়ে ওঠার। যদি এই ব্যাপারটা আমাদের কারও মাঝে চলে আসে, তাহলে আমাদের অবশ্যই উচিত সঙ্গী কিংবা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা। সঙ্গীর কোন দিকটা আমাদের খারাপ লাগছে, কিংবা কোন ব্যাপারটা আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, তা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা, সম্পর্কটা স্বচ্ছ রাখা। নিজের ওপর, সঙ্গীর ওপর, এক কথায় পুরো সম্পর্কটার ওপর আমাদের বিশ্বাস বাড়াতে হবে। ড. হেলাল বলেন, ‘প্রতিটা সম্পর্ক হওয়া উচিত শ্রদ্ধার, সম্মানের, বিশ্বাসের। সম্পর্ক হতে হবে স্বচ্ছ, সাবলীল। সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং সম্পর্কটা নিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস ঠিক থাকলে কোনো সম্পর্কেই নিরাপত্তাহীনতার ভয় থাকে না। আর নিরাপত্তাহীনতা না থাকলে পজেসিভনেস ব্যাপারটা থেকে আমরা সহজেই দূরে থাকতে পারি।’
সোর্স – প্রথম আলো।
Leave a Reply