ডা· পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,
মহাখালী, ঢাকা
কেমোথেরাপি ক্যান্সার-কোষ ধ্বংস করে। কিন্তু হরমোন থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধ শরীরের স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং ক্যান্সার-কোষ জ্নাতে বাধা দেয়। হরমোন হলো প্রাকৃতিক রাসায়নিক যৌগ, যা শরীরের বিভিন্ন কাজের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন রক্তে চিনির মাত্রা, হাড়ের বৃদ্ধি এবং মায়ের স্তনে শিশুর দুধ তৈরি ইত্যাদি। অ্যাড্রেনালিন, ইনসুলিন, ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন প্রভৃতি হরমোনের উদাহরণ। কোনো কোনো স্তন ক্যান্সার সৃষ্টির জন্যই ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের প্রয়োজন হয়। তাই হরমোনসম ওষুধ প্রয়োগ করা হলে হরমোনের কাজে বাধা দেয়। ফলে ক্যান্সার-কোষ সৃষ্টি কমে একসময় একেবারেই থেমে যায়।
হরমোন থেরাপি কীভাবে কাজ করে
স্তন ক্যান্সার, ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন দিয়ে প্রভাবিত হয়ে থাকলে ক্যান্সার-কোষের আবরণীর স্থানে স্থানে হরমোন রিসেপটরও থাকে। হরমোন সেসব রিসেপটরে তালার মতো এঁটে যায় এবং কোষকে কোষবিভাজনের জন্য নাড়া দেয়।
হরমোন থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধ (ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের মতো কিন্তু হুবহু ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন নয়) সেই রিসেপটরে লাগসই হয় এবং ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরনের স্থান দখল করে।
এর ফলে ক্যান্সার-কোষ কোষবিভাজনের জন্য উদ্বুদ্ধ হয় না, ফলে ক্যান্সার-কোষ জ্নায়ও না। হরমোন থেরাপির ভালো কাজ করা না-করা নির্ভর করে হরমোন রিসেপটরের উপস্থিতি এবং এর মাত্রার ওপর। রিসেপটরের উপস্থিতি জানার জন্য অপারেশনের সময় স্তন ক্যান্সারের পিণ্ড থেকে টিস্যু নিয়ে নিতে হয় এবং বিশেষ ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের পরীক্ষা করা হয়। রিসেপটর নির্ণয় করা গেলে তাকে বলে রিসেপটর প্লাস এবং রিসেপটর অনুপস্থিত মানে রিসেপটর মাইনাস।
কীভাবে হরমোন থেরাপি দেওয়া হয়
অপারেশনের কয়েক সপ্তাহ পর থেকে হরমোন থেরাপি শুরু করা হয়। সাধারণত খাওয়ার বড়ি হিসেবে এ ওষুধ প্রতিদিন সেবন করতে হয়। রোগীর যদি কেমোথেরাপি চিকিৎসারও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে মেডিকেল অনকোলজিস্টের তত্ত্বাবধানে হরমোন থেরাপি ও কেমোথেরাপি সমন্বয় করে চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।
কত দিন হরমোন থেরাপি চালিয়ে যেতে হবে
দীর্ঘদিন ধরে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত অজস্র রোগীকে হরমোন থেরাপি প্রয়োগ করে বহু গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে পাঁচ বছর ধরে অ্যান্টি-ইস্ট্রোজেন (টেমোক্সিফেন) চালিয়ে গেলে রোগ শরীরের অন্য স্থানে এবং অন্য স্তনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
তবে পাঁচ বছরের বেশি এ ওষুধ সেবন করলে তেমন কোনো কাজ হয় না। আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ওষুধে কোনো কাজ নাও হতে পারে। ওষুধ পাঁচ বছর সেবন করার পর পরবর্তী ১০ বছর পর্যন্ত এ ওষুধের কার্যকারিতা বজায় থাকে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই বলা যায় টেমোক্সিফেন বড়ি পাঁচ বছর সেবন করাই ভালো এবং এটি স্বীকৃত চিকিৎসা।
সাম্প্রতিককালে অ্যারোমেটিস ইনহিবিটরস নামে আরও নতুন কিছু ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। অ্যারোমেটিস এক ধরনের প্রাকৃতিক এনজাইম, যার সাহায্যে মেয়েদের সুপ্রারেনাল গ্লান্ড থেকে (ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে গেলেও) ইস্ট্রোজেন তৈরি হয়। অ্যারোমেটিস এনজাইমের কাজকে বাধা দিতে পারলে কার্যকরভাবে ইস্ট্রোজেন তৈরি বন্ধ করা যায়।
ফলে ইস্ট্রোজেন-নির্ভরশীল স্তন ক্যান্সারের কোষের সৃষ্টিও থেমে যায়। ফিমারা, এরিমিডেক্স, অ্যারোমেসিন প্রভৃতি অ্যারোমেটিস ইনহিবিটরস ওষুধ। বর্তমানে মেনোপজ হওয়া নারীদের (যাদের মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে) জন্য এ ধরনের হরমোন থেরাপি স্বীকৃত।
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত যেসব রোগীর জন্য হরমোন থেরাপি প্রয়োজন
ক্যান্সার যদি স্তনে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে কার্যকরভাবে চিকিৎসা দেওয়া যায়। আর যদি ক্যান্সার স্তনের বাইরে দূরের কোন অঙ্গে ছড়িয়ে যায়, তাহলে চিকিৎসা দিয়ে ক্যান্সার মুক্ত করা খুবই কঠিন। স্তন ক্যান্সার নির্ণয়কালে রোগ দূরের অঙ্গে ছড়িয়ে যাওয়ার চিহ্ন সব সময় নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
সে জন্য স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় সহায়ক চিকিৎসা, যেমন-কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি অথবা উভয় চিকিৎসাই দেওয়া হয়। এসব চিকিৎসা দেওয়ার জন্য রোগীর দূরের অঙ্গে রোগ ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা বিবেচনা করা হয়।
ঋতুমতী নারীদের ক্ষেত্রে প্রায়ই ইস্ট্রোজেন রিসেপটর টিউমার নেগেটিভ হয়ে থাকে। সহায়ক হিসেবে হরমোন থেরাপি তাদের জন্য কার্যকর হয় না। আবার পজেটিভ হলে হরমোন থেরাপি ভালো কাজ করে।
ঋতুবন্ধ (মেনোপজ) হয়েছে, এমন নারীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইস্ট্রোজেন রিসেপটর টিউমার পজেটিভ পাওয়া যায়। ফলে তাঁদের ক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি ভালো কাজ করে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
মেনোপজের মতো উপসর্গঃ হরমোন থেরাপি ইস্ট্রোজেন হরমোন বা হরমোনের কাজকে বাধা দেয়। তাই মাসিক বন্ধ হওয়ার বয়সে যেসব উপসর্গ দেখা দেয়, হরমোন থেরাপিতে প্রায় সে রকমই উপসর্গ হতে পারে। যেমন-গরম ভাব, মাসিকের পরিবর্তন ও যোনিপথের বিভিন্ন উপসর্গ (শুষ্কতা, চুলকানি, কখনো বা রস বের হওয়া)।
খুব কমসংখ্যক রোগীর মুখে দাড়ি-গোঁফ হওয়ার মতো উপসর্গও হতে পারে। হরমোন থেরাপি, বিশেষ করে টেমোক্সিফেনে জরায়ু ক্যান্সার (ইউটেরাস) হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
গর্ভধারণঃ টেমোক্সিফেন বড়িতে একদিকে যেমন মাসিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আবার সে সময় গর্ভধারণও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু টেমোক্সিফেন ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর।
তাই এ সময় গর্ভধারণে সক্ষম রোগীর জন্য পরিবার পরিকল্পনার ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার ব্যবস্থা হিসেবে প্রোটেকশন ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই জ্ননিয়ন্ত্রণ বড়ি বা ইনজেশন ব্যবহার করা যাবে না। তাতে হরমোন থেরাপির কাজে বিঘ্ন ঘটবে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০০৮
Leave a Reply