অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
বার্তা সংস্থা সিএনএন বিশ্বনন্দিত নাম। এর মেডিকেল ইউনিটের ম্যানেজার এন কার্লি বলছিলেন তাঁর জীবনকথা। আপনাদের জানানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। সেই ভদ্রমহিলা ছিলেন টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগী। ৪০ বছর ধরে। এন কার্লি যখন খুব ছোট, মাত্র সাত বছর বয়স, তখন মা তাকে নিয়ে গেলেন চিকিৎসকের কাছে। বেশ ওজন কমে গিয়েছিল তার শরীর থেকে। অথচ ক্ষুধা ছিল খুব বেশি। তার পরিবার বাসস্থান পরিবর্তন করে সানফ্রান্সিসকো থেকে সরে এসেছিল প্যাসাডেনা, ক্যালিফোর্নিয়ায়। চিকিৎসকের চেম্বারে দেখা হলো যার সঙ্গে, তার প্রবল প্রভাব পড়ল তার জীবনে। জীবনের মোড়ই ঘুরে গেল তার জন্য।
ডা· রবার্ট ডেপুটি। শিশুবিশেষজ্ঞ ডা· রবার্ট নির্ণয় করলেন, এন কার্লির রয়েছে ডায়াবেটিস। মা সঙ্গে ছিলেন কিন্তু মাকে তা না বলে সরাসরি তাকেই বললেন ডা· রবার্ট। প্রশ্নও করলেন কয়েকটি। তার কি পিপাসা লাগে? রাতে কি প্রস্রাব করার জন্য উঠতে হয়? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর ছিল, হ্যাঁ। প্রস্রাবের নমুনা নেওয়া হলো তার। প্রস্রাবে সুগার পাওয়া গেল। ডা· ডিপুটি তাকে তো বললেনই, মাকেও বললেন যে শরীরে তার সুগার ঠিকমতো ব্যবহার হচ্ছে না। তার হয়েছে ডায়াবেটিস।
এভাবেই শুরু হলো তার ৪০ বছরের ডায়াবেটিক জীবন। এরপর হাসপাতালে গিয়ে ছোট্ট এন শিখল কী করে প্রস্রাবে সুগার পরীক্ষা করতে হয়, কীভাবে নিজে নিজে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ডায়াবেটিক ডায়েট কীভাবে অনুসরণ করতে হয় এবং ডায়াবেটিস কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। হাসপাতালে কয়েক দিন থেকে ব্যবস্থাপনা করার সব কৌশলও শেখা হলো তার। এরপর বাড়িতে।
প্রতিদিন বিকেল ও সন্ধ্যায় ডা· ডেপুটি আসতেন তার বাড়িতে বা খবর নিতেন কেমন চলছে ডায়াবেটিক জীবন। তার মা-বাবার এবং তার নিজেরও খুব আনন্দ লাগত। ডা· ডেপুটি চাইতেন, এন নিজেই নিজের রোগকে সামলাক। অনেক ডায়াবেটিসের রোগী মনে করেন, রোগটি বোঝা হয়েছ অথচ এন কার্লির মনে হতো ডায়াবেটিস হয়ে বরং শাপেবর হয়েছে। এতে পরিবারের সবাইকে জোর করেই খেতে হতো বরং স্বাস্থ্যকর খাবার-এ অসুখ হওয়ায় ভালো পুষ্টিমান হলো তার। প্রতিদিন এর চর্চা হতো তার। বেশির ভাগ খাবারে কী পরিমাণ শর্করা রয়েছে, ইতিমধ্যে তা সব জানা হয়ে গেল তার, আর খাওয়া-দাওয়ার সব বিষয় এত জানা হলো তার যে অনেকেই এত জানত না সেসব সম্পর্কে। শরীরচর্চা করা জীবনে সক্রিয় থাকা হলো উচ্চ রক্ত শর্করা পোড়ানোর আরেকটি উপায়। তাই প্রস্রাবে যখন গ্লুকোজ পাওয়া যেত, তখন তার বোন রবিন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসত। জাম্পরোপ বা দড়িলাফ খেলা চলত তখন, নয়তো বাইকে চড়ে শহর ঘোরা হতো, নয়তো রোলার স্কেটার···। সে ও তার বোন দুজনই ছিল খুব সক্রিয় ও দৈহিকভাবে ফিট। নিজেকে তার মনে হতো পাগলা বিজ্ঞানীর মতো, কাচের পরীক্ষানলে প্রস্রাবের নমুনা, সলুশন, একটু তাপ দিয়ে উত্তপ্ত করা-টেস্ট করে দেখত সুগার আছে কি না।
কালক্রমে প্রযুক্তি উন্নত হলো। আবিষ্কৃত হলো টেস্ট স্ট্রিপ। এগুলো মূত্রে ডোবালে বোঝা যায় যে এতে সুগার আছে কি না। স্ট্রিপে বর্ণবদল হয়, সুগারের পরিমাণও আনুমানিক জানা যায়। তবে সত্য কথা যা, তা হলো প্রস্রাবে সুগার পরীক্ষা করে দেখা একটি পুরোনো কালের টেস্ট বটে। প্রস্রাবে সুগার আসতে আসতে শরীরে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, সংকেত হয়ে গেছে যে সুগার বিপাকের জন্য শরীরে ইনসুলিন তেমন নেই। আর প্রস্রাব পরীক্ষা করে কী পরিমাণ সুগার রক্তে আছে, তা সঠিক বোঝাও যায় না।
১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে এল হোম ব্লাড গ্লুকোজ টেস্টিং কিট। ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এল বড় ধরনের অগ্রগতি। এই কিট ব্যবহার করে ডায়াবেটিসের রোগী আঙ্গুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। রক্তের ফোঁটা রাখা হয় টেস্ট স্ট্রিপে। সেই স্ট্রিপটি ঢোকানো হয় রক্তের সুগার পরিমাপক যন্ত্রে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডায়ালে ফুটে ওঠে রক্তের সুগারের পরিমাণ। প্রথম প্রথম এন দিনে কয়েকবার আঙুলের ডগা ফুটো করে রক্তের নমুনা নিতে বিরক্ত বোধ করত, এখন তা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
১৯৮০ সালের দিকে আরও এল ইনসুলিন পাম্প। এ যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা পেজারের মতো। এতে রয়েছে ইনসুলিন ভাণ্ডার। এর সঙ্গে একটি নল লাগানো, যা একটি ছোট্ট প্লাস্টিক সান্টের সাহায্যে শরীরে ইনসুলিন ভরে দেয়। তাই বারবার ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়ার পরিবর্তে সেই পাম্প থেকে ইনসুলিন ভরা হয় শরীরে, সুস্থিত থাকে রক্তের সুগার। ডায়াবেটিসের ভুবনে আরেকটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন হলো, সিজিএম বা কন্টিনিউয়াস গ্লুকোজ মনিটর, সম্প্রতি উদ্ভাবিত এ যন্ত্রটি।
এই ছোট্ট যন্ত্রটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পেট, ঊরু, পা বা কোমরের ত্বকের নিচে। এতে রয়েছে খুব ছোট সেন্সর, যা দেহতরলে গ্লুকোজ মান পরিমাপে সক্ষম। এই উপাত্ত বা তথ্য সম্প্রসারিত হয় একটি গ্রাহকযন্ত্রে, রোগীরা তাদের রক্ত সুগার মান অনবরত লক্ষ করতে পারে। তবে ল্যাবরেটরিতে রক্তের নমুনা নিয়ে সুগারের পরিমাণ মাপার মতো নিখুঁত ও সঠিক উপায়ের বিকল্প নেই। তবে টাইপ-১ ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সিজিএম প্রযুক্তি বড় রকমের অগ্রগতি, সন্দেহ নেই। একে বলা হচ্ছে ‘ক্লোজড লুপ সিস্টেম’। কোনো একদিন ডায়াবেটিসের রোগী এমন এক পাম্প পরিধান করে থাকবেন, সেটি এমন নিখুঁত এক সেন্সরের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করবে, পাম্পটি এমন প্রোগ্রামড হয়ে যাবে যে এটি নিজে নিজে কাজ শুরু করবে এবং রক্তের সুগার অনুযায়ী সব রকম অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে সক্ষম হবে।
বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হলো এমন একটি পাম্প তৈরি করা, যা কিছুটা রোবটিক ডেলিভারি সিস্টেমের মতো কাজ করবে। রোগীর একমাত্র কাজ হবে কেবল একে পরে নেওয়া, বাকি কাজ যন্ত্রই করবে। সে তার বোন রবিনকে বলল, আবার ডা· ডেপুটির খোঁজ নিতে। যখন তার বয়স সাত ছিল, তখন তিনি তাকে যা বলেছিলেন, তা অনেক বদলেছে। ৪০ বছর আগে এসব ডায়াবেটিক প্রযুক্তি যেমন- ইনসুলিন পাম্প, সিজিএম, এবং রক্তের সুগার পরীক্ষার মতো প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে রোগীরা রোগ সস্পর্কে ধারণা পেত সামান্য, ভবিষ্যৎও জানত অস্পষ্ট। ডা· ডেপুটি তার মা-বাবাকে বলেছিলেন, এন বেঁচে থাকবে মাত্র ২০ থেকে ৩০ বছর। কিন্তু তা তো পেরিয়ে অনেক বছর গেল।
ডা· ডেপুটি এখন চিকিৎসা পরিষেবা থেকে অবসর নিয়েছেন, তবু চিনলেন এনকে। যখন তাকে সে রোগ-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলল, তখনকার সময় এটুকুই বোঝা যেত, অস্পষ্ট ছিল ধারণা-প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে সবই বদলায়। পাম্প ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিরও উন্নতি হয়েছে। ডা· ডেপুটি বরং আশ্বস্ত হলেন রোগ-ভবিষ্যৎ তিনি যা করেছিলেন, তা ভুল প্রমাণ হয়েছে। সে আরও বাঁচবে বেশি দিন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৬, ২০০৮
Leave a Reply