প্রাণের স্পন্দন আর শিল্পকর্মের নান্দনিকতা এক সুতোয় প্রকাশ পায় বলেই বনসাই জীবন্ত শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত। নগরে ইটের স্থাপনার মধ্যে এক টুকরো সবুজের উপস্থিতি এবং স্বল্প পরিসরে সহজ যত্ন-আত্তিতে বনসাই সংগ্রহ করা যায় বলেই বৃক্ষপ্রিয় মানুষের কাছে বনসাইয়ের কদর যেন একটু বেশিই।
বহু বছর আগে চীন দেশে এই শিল্পের সূচনা হলেও পরবর্তী সময়ে এটি জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়। আজকাল শৌখিন সংগ্রহের পাশাপাশি ঘর সাজাতে এবং অন্যান্য ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজে বনসাই ব্যবহার করা হয়। মূল গাছের সব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে, অগভীর ছোট পাত্রে বৃক্ষজাতীয় গাছের ক্ষুদ্র সংস্করণ গড়ে তোলার কাজকেই বনসাইশিল্প বলা হয়। ক্ষুদ্র এই সংস্করণটিই বনসাই হিসেবে পরিচিত। স্বল্প পরিসরে প্রকৃতির উপলব্ধি করাই বনসাই চাষের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি সৈয়দ মাহফুজ-ই তৌহিদ বলেন, নিজস্ব পছন্দ করা গাছের পাশাপাশি দেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় অনেক গাছ সংগ্রহ করে রাখা যায় বনসাইয়ের মাধ্যমে। দেশীয় সব বৃক্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশের তাপমাত্রায় সহনশীল যেকোনো বিদেশি গাছের বনসাই করা যায়। তবে সাধারণত শেওড়া, হিজল, তমাল, তেঁতুল, বিভিন্ন প্রজাতির বট, পাকুর, ঘূর্ণিবিচি, কামিনীসহ জেড, সাইকাস ও অন্যান্য বৃক্ষ থেকে বনসাই করা হয়ে থাকে।
ঢাকার ধানমন্ডির মাহবুব হোসেন ব্যক্তিগতভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রহ করছেন বনসাই। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বনসাই তৈরির নিয়ম।
নিজেই তৈরি করুন বনসাই
যে গাছটির বনসাই তৈরি করবেন, সেটার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ভালোভাবে জেনে নিন। নির্বাচিত গাছের বিচি থেকে চারা তৈরি করে নিতে পারেন অথবা নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করে তা থেকে বনসাই তৈরি করতে পারেন। বনসাইয়ের মাটি তৈরির ক্ষেত্রে দো-আঁশ বা পলিমাটির সঙ্গে পরিমিত জৈব সার ব্যবহার করুন। পানি নিষ্কাশন ও গাছের বৃদ্ধি রোধে বিশেষভাবে তৈরি টবেই বনসাইয়ের চারা রোপণ করতে হবে। এই টবের নিচের দিকে পানি নিষ্কাশনের এবং কিনারা বরাবর দুই বা ততোধিক ছিদ্র থাকে, যা তার পেঁচিয়ে গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে রাখে।
কিছুদিন বৃদ্ধির পর গাছটির জন্য উপযুক্ত আকৃতি নির্ধারণ করে ডালপালায় তার পেঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি নিয়মিত অবাঞ্ছিত ডাল-পাতা ছাঁটাই করতে থাকুন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হবে আপনার বনসাইটি। ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহীতেও বনসাইয়ের প্রসার ব্যাপক। রাজশাহীর বনসাই সোসাইটির সদস্য রাজু আহমেদ বলেন, বনসাই তৈরি করা একটি দীর্ঘ সময়ের সৃষ্টিকর্ম। তাই আপনি যদি শৌখিনভাবে তৈরি করা বনসাই সংগ্রহ করতে চান, তাও করতে পারেন। বর্তমানে বিভিন্ন বনসাই সোসাইটি, ব্যক্তিগত সংগ্রহকারী এমনকি নার্সারিতেও কিনতে পাওয়া যায় এটি। তবে বনসাইয়ের দরদাম নির্ভর করে গাছের বয়স ও গঠনের ওপর। সর্বনিম্ন তিন হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকায় বনসাই ক্রয় করতে পারেন। তবে মোটামুটি ভালোমানের একটি বনসাইয়ের জন্য ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা বাজেট রাখতে পারেন।
বিভিন্ন বনসাই প্রদর্শনী, কৃষিমেলা এমনকি বনসাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকেও আপনি বনসাই সংগ্রহ করতে পারেন। তবে যেভাবেই আপনি বনসাই সংগ্রহ করুন না কেন, এই জীবন্ত শিল্পকর্মটি বাঁচিয়ে রাখতে আপনাকে অবশ্যই এর যত্ন নেওয়ার কৌশল জানতে হবে।
বনসাইয়ের পরিচর্যা
একটু আন্তরিকতাপূর্ণ দেখভাল আপনার বনসাইটিকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি ঝামেলার দরকার হয় না। বনসাইয়ের পরিচর্যার ব্যাপারে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি থেকে জানা গেল—
গাছকে নিয়মিত খাবার দিন। যেমন, কালো মাটি, বালু বা ইটের চূর্ণ, সরিষা বা নীলের খোসা ইত্যাদি।
বনসাই অতিরিক্ত পানিবদ্ধতা এবং রোদ— কোনোটাই সহ্য করতে পারে না। তাই এ বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
বনসাই ধুলা-ময়লামুক্ত রাখতে পানি দিয়ে পাতা ও ডাল মুছে দিন।
টবের মাটিতে পোকামাকড় কিংবা ছত্রাকের প্রাদুর্ভাব হলে সঠিক মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করুন।
এমন স্থানে রাখুন, যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করে কিন্তু লোকজনের যাওয়া-আসা কম।
নির্ধারিত আকৃতি ঠিক রাখতে নির্ধারিত ডালপালা বাদে ছাঁটাই করুন।
বেশি ব্যস্ত থাকলে সঠিক মাত্রায় তরল বা স্পেস সার প্রয়োগ করতে পারেন।
অবশ্যই প্রতি এক বছর অন্তর টবের মাটি পরিবর্তন করুন।
গাছের ছাঁটাইসহ অন্যান্য কাজে বনসাই পরিচর্যার জন্য নির্ধারিত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করুন।
কোনো কারণে বনসাইটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, যেখান থেকে কিনেছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
ব্যক্তিগতভাবে বনসাই সংগ্রহ করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলুন।
খেয়াল রাখবেন
কখনোই শুধু দামের ভিত্তিতে বনসাইয়ের ভালো-মন্দ নির্বাচন করবেন না। ক্রয়কালে খেয়াল রাখুন—
বনসাইটির রুট বেইস ভালো কি না?
প্রাকৃতিকভাবেই গাছটি সৌন্দর্য প্রকাশ করছে কি না।
গাছের বাকলে বয়সের ছাপ স্পষ্ট কি না। ভালো বনসাইয়ের মূল কাণ্ড মসৃণ ও দাগমুক্ত হয়।
বনসাইটি আদি বৃক্ষের বৈশিষ্ট্য বহন করে কি না।
প্রশিক্ষণ
বনসাই তৈরি করা কিংবা পরিচর্যার জন্য আপনি স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণও নিয়ে ফেলতে পারেন। এ জন্য ধানমন্ডি ও উত্তরার বিভিন্ন নার্সারিসহ বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটিতে খোঁজ নিতে পারেন।
ঠিকানা: বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি
১৪১/৪ আবেদ ঢালী রোড (নিচতলা), কলাবাগান, ঢাকা।
ফোন: ০১৭১১৩৪৮৮৪৬
শিল্পকর্মের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা নিরেট গৃহসজ্জার বস্তু থাকে না, এটি আপনারই একটি অংশ হয়ে ওঠে। সবুজের উপস্থিতি আপনাকে শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রশান্ত রাখে এবং আরও উদ্যমী করে তোলে। একটি প্রাণের উপস্থিতিই অন্য একটি প্রাণের উৎসাহ জোগায়।
অর্পিতা অর্পি
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৯, ২০১১
Leave a Reply