মাটির পটারি শুকানোর পর রং করার কাজ শেষ এক তাল কাদা মাটিকে ইচ্ছেমতো গড়া যায়। কারও হাতে মাটির তাল ঢেলায় পরিণত হয়, আবার কারও হাতে এই কাদামাটির তালই হয়ে ওঠে অপরূপ কোনো শিল্পকর্ম। কখনো ঘর গেরস্থালির কেজো কোনো জিনিস। সেগুলোর স্থান হয় তখন মানুষের ঘরে ঘরে। নাগরিক অন্দরে মাটির পটারি, ফুলের টব থেকে শুরু করে এখন মাটির থালা-বাটিও উঠে আসে নান্দনিকতা আর সুরুচির প্রতীক হিসেবে। এসব শৈল্পিক মৃৎশিল্পের সঙ্গে ধামরাইয়ের নামটাই চলে আসে সবার আগে। বিশেষ করে, মাটির শৌখিন জিনিসপত্র তৈরিতে এ অঞ্চলের ‘পাল’ সম্প্রদায় বেশ সিদ্ধহস্ত।
শুধু মাটি নয়, ধামরাইয়ের কাঁসাশিল্পের সুনাম আছে।
এখানে তৈরি কাঁসার শিল্পকর্ম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে। তাই তো ধামরাইয়ে গিয়ে মাটি আর কাঁসা দেখে আসা।
ঢাকা-পাটুরিয়া মহাসড়কে নবীনগর মানে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পার হলে নয়ারহাট।
এরপর পড়বে বংশী নদীর ওপর বড় সেতু। সেতু পেরোলেই ইসলামপুর বাসস্ট্যান্ড। ডানে আমাদের গন্তব্য—কাগুজি পাড়া। এখানেই পাল সম্প্রদায়ের বসবাস। বংশী নদীর তীরঘেঁষে ধামরাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন এই মাটির কারিগরেরা। পালদের আবাস গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে। বংশপরম্পরায় শত বছরের বেশি সময় ধরে পালেরা ধরে রেখেছেন মাটির এই কাজকর্ম।
কাগুজি পাড়ায় প্রথমেই দেখা গোবিন্দ পালের সঙ্গে। নিজের ঘরে হাতির আকৃতি একটি কাঁচা মাটির ব্যাংকে নকশা করছেন। এ কাজে আছেন ৩৫ বছর ধরেই। পাশেই বসা সন্তোষ পাল, নদীরাম পাল, সুমন্ত পাল ও হারাধন পাল। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আরও বেশি। গোবিন্দ জানালেন, ‘আগে তৈরি হতো হাঁড়ি, কলসি ইত্যাদি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাটির টব, ফুলদানি, টেরাকোটার শিল্পকর্ম, টালি—এসবের চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী কাজ করি, তবে নকশাটা আমাদের।’
যে মাটি দিয়ে নানা রকম জিনিসপত্র বানানো হয়, সেই এঁটেল মাটি আনতে হয় দূরের বিভিন্ন এলাকা থেকে। ‘মাটি আসার পর সেগুলো জল দিয়ে গুলে কাদা বানাই আমরা। টব তৈরি করলে সেই কাদা লোহার ছাঁচে ফেলা হয়। আর নকশাদার অন্যান্য জিনিসের জন্য প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে ছাঁচ তৈরি করা করা হয়। কলসি, হাঁড়ি ইত্যাদি বানানো হয় চাকায় কাদার তাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। এখানে এর ব্যবহার কম।’ জানালেন মৃৎশিল্পীরা। ছাঁচে ফেলে আদলটা বানানো হলো নকশা আঁকা বা খুঁতগুলো দূর করা হয়। এরপর শুকানোর পালা। তারপর পোড়ানো হয় সেসব জিনিস। টেরাকোটার ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া।
ধারণা ছিল, পোড়ানোর তারতম্যের কারণেই বুঝি মাটির কোনো জিনিস লাল, কোনো জিনিস কালো বা অন্য রঙের হয়। লতা রাণী পালের কথায় জানা হলো, শুকানোর পরই রং করা হয়। এ রংটা মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর পর আরও পাকা হয়।
চৈত্রের দুপুর তখন। কাগুজি পাড়ায় তখনো কোনো চুলায় আগুন চোখে পড়েনি। একজন বললেন, ‘এক বাড়িতে এখন টব পোড়ানোর কাজ চলছে। চলেন যাই।’ গেলাম বল্লভ পালের বাড়ি। প্রথম দর্শনে মনে হলো, ধানের একটা গোলা উল্টো করে রাখা হয়েছে। নিচে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টা হলো, চুলার ওপর এক হাজারের মতো কাঁচা মাটির শুকনো টব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার ওপর খড় ও মাটি দিয়ে একটা আবরণ তৈরি করা হয়েছে। এরপর সেটি কাদা দিয়ে লেপে দেওয়া হচ্ছে। নিচে ধীরে ধীরে আগুন দেওয়া হচ্ছে। খড় আর মাটির যে আবরণ, সেটির নিচে কয়েকটা ছিদ্র। আগুন যখন জোরেশোরে জ্বলবে, তখন এসব ছিদ্র দিয়েই বেরোবে ধোঁয়া আর আগুন। সাত দিনে ধরে জ্বলবে এই আগুন। তাতে মাটির জিনিসগুলো পুড়ে পুড়ে হয়ে উঠবে মৃৎশিল্প।
বংশী নদীর পাড়ে কাগুজি পাড়া, টেক পাড়া, ব্রজের টেক, নলাম, কাকরান—এসব গ্রামেই পালদের বসবাস। প্রতিটি গ্রামেই হয় মাটির কাজ। আগের চেয়ে এখন কাজ বেশি প্রত্যেকের। পুরো পরিবার মাটির জিনিস তৈরির সঙ্গে জড়িত। ঘুরতে ঘুরতে জানা হলো, বংশী নদীর ওপারে কাকরানে শৌখিন জিনিস বেশি তৈরি হয়। আবার মহাসড়ক ঘুরে বংশীর তীরঘেঁষে আমরা যাই নলামে। নলাম ঘাটে খেয়াপার হলেই কাকরান। বৈঠা নৌকায় পারাপার। নদী দেখে মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। নাকে হাত চলে যায় আপনা-আপনি। নদীর পানি পুরো কালো আর দুর্গন্ধ। সাভার ইপিজেডের শিল্পবর্জ্যে বেহাল বংশী। মাঝিরা জানান, এ নদীতে মাছ নেই।
ধামরাইয়ের ভাড়ারিয়া ইউনিয়নে পড়েছে কাকরানের পাল পাড়া। জগদীশ পালের বাড়িতে দেখা গেল সারিবদ্ধ দারুণ সব পটারি। লম্বা লম্বা ফুলদানিগুলো দাঁড় করানো তাঁর বাড়ির উঠোনে। পটভূমিতে পানিহীন বংশী নদীতে সবুজ ধানখেত। জগদীশ নিজে বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘৭০ ঘর কারিগরের বসবাস কাকরানে। অর্ডারি কাজ করেন সবাই। মাটির থালা-বাটি থেকে শুরু করে টব, ফুলদানি, দইয়ের হাঁড়ি—অনেক কিছুই তৈরি হয় এ গ্রামে।’
ধামরাইয়ের এই গ্রামগুলোতে গিয়ে সরাসরি মাটির জিনিসও কেনা যায়। আবার সাভারের নবীনগরে কিছু দোকানে এঁদের তৈরি মৃৎশিল্প বিক্রি হয়। আর ঢাকার বিভিন্ন দোকান-বাজার তো আছেই।
খাসা কাঁসা
তালা খুলে ঘরের আলোটা যেই জ্বাললেন সুকান্ত বণিক, চোখ প্রায় ধাঁধিয়ে গেল চকচকে সোনালি রঙে। মনে হলো, সোনার তৈরি ভাস্কর্যে ভরা কোনো জাদুঘরে বুঝি দাঁড়িয়ে আছি। আসলে এটা কাঁসার তৈরি নানা রকম শিল্পকর্মের একটা শোরুম।
ধামরাইয়ে মাটির পর যাই কাঁসার সন্ধানে। কয়েকজন কাঁসার শৈল্পিক জিনিসপত্র বানান। এর মধ্যে রথখোলার কায়েতপাড়ার সুকান্ত বণিকের কারখানার কথাই সবাই বললেন। কায়েতপাড়া ঢুকতেই রাস্তাঘেঁষা মন্দিরের চাতালে দেখা গেল বিশাল এক রথ। জানা গেল, এটা ভারত সরকারের উপহার। কিছুটা এগোতেই সাবেকি আমলের দোতলা বাড়ি। বারান্দাতেই দেখা সুকান্তের সঙ্গে। এটাই তাঁর বাড়ি, শোরুম, কারখানা—সবকিছু।
কাঁসার হাতি, ঘোড়া, পালকি, দাবার সেট, সেনাবাহিনী, বুদ্ধমূর্তি, রাধাকৃষ্ণ, নৌকা, হাতিবহর—কী নেই সুকান্তর এখানে! পাল সম্প্রদায়ের ২২ জন কারিগরকে দিয়ে কাজ করান। সব নতুন। কিছু চকচকে, আবার কাঁসার কিছু শিল্পকর্মে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া। ‘থালা, বাটি, কলসি—আগে কাঁসা দিয়ে গেরস্থালির জিনিসপত্রই হতো এখানে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে শুরু হয়েছে মূর্তি বা শিল্পকর্ম তৈরি।’ জানালেন সুকান্ত বণিক।
২০০ বছরের পুরোনো পারিবারিক এই ব্যবসা। লালবিহারী বণিক, শরৎচন্দ্র বণিক, সর্বোমোহন বণিক, ফণিভূষণ বণিকের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সুকান্ত বণিক এখন ধরেছেন এই ব্যবসার হাল। আর চালাচ্ছেনও ভালো। দেশি-বিদেশি ক্রেতা তাঁর। বললেন, ‘৫০০ বছর আগের লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে কাঁসার শিল্পকর্ম তৈরি করা হয় এখানে। মৌচাকের মোম আর প্যারাফিনের মিশেল দিয়ে প্রথমে যেকোনো জিনিসের আদলটা গড়া হয়। এর ওপর তিন স্তরে দেওয়া হয় মাটি। সেটা শুকিয়ে গেলে পোড়ানোর কাজ। আগুনের তাপে মোম গলে বেরিয়ে আসে। এরপর মাটির ফাঁপা অংশে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলিত কাঁসা ঢেলে দেওয়া হয়। একদম শুরুতে মোম যে আদলে ছিল, সেটাই তৈরি হয় কাঁসায়। তারপর ওপরের মাটি ভেঙে ফেলা হয়। সবশেষে ফিনিশিংয়ের কাজ করেন কারুশিল্পী।’
এ তো গেল ভরাট কাঁসার জিনিস তৈরির নিয়ম। সুকান্ত জানালেন, বড় বড় যেসব মূর্তি বা অন্য কিছু কাঁসা দিয়ে তৈরি করা হয়, সেগুলোর ভেতরটা থাকে ফাঁপা। সেটা তৈরির পদ্ধতি হলো, প্রথমে খড় দিয়ে মূর্তির কাঠামো বানানো হয়। খড় লেপা হয় মাটি দিয়ে। এই ধাপে আদলটা এসে যায়। মোমের পাত দিয়ে এই আদলটা ঢেকে দেওয়া হয়। তার ওপর আবার কাদামাটির প্রলেপ। শুকানো হলে আগুনে পোড়ানোর পালা। দুই পরত মাটির মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে মোম। সেই ফাঁকা অংশে ঢালা হয় কাঁসা।
কাঁসা আর পিতলের পার্থক্যও জানা হলো। কাঁসা হলো রাং ও তামার মিশ্রণ। আর পিতল তামা ও দস্তার মিশেলে তৈরি হয়। কাঁসার দাম এখন প্রতি কেজি এক হাজার ১০০ টাকা, পিতল ৪০০ টাকা। কাঁসায় সব খাবার রাখা যায়, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় না। কাঁসার শব্দটাও হয় খুব ভালো।
কথা বলতে বলতে সুকান্ত একটা কাঁসার কারুকাজ করা বাটি হাতে নিলেন। কাঠের একটা হামানদিস্তা হাতে নিলেন। ধীরে ধীরে ঘোরাতে লাগলেন বাটিটার কিনারা ধরে। প্রথম গুঞ্জন শুরু হলো। এরপর গম গম, বাড়তে থাকে আওয়াজ। মেডিটেশন করার জন্য এটা বেশ কার্যকর। আমাদের জন্য ধ্যানস্থ হতে অবশ্য এই বিশেষ বাটির দরকার হয় না। চোখ আটকে যায় কাঁসায় করা দুর্দান্ত সব কারুকাজে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক বিস্ময়ে শুধুই তাকিয়ে থাকি। পালদের শৈল্পিক নকশায় যেন আমাদের ধ্যানস্থ করে ফেলে।
পল্লব মোহাইমেন ও অরূপ রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৯, ২০১১
Leave a Reply