দুজনে মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। প্রথম বিবাহবার্ষিকী এভাবেই কাটাতে চেয়েছিলেন ঈশিতা। বর জামিলও সায় দিয়েছিলেন। তবে মনে মনে চাইছিলেন বন্ধুবান্ধবের নিয়ে কোনো রেস্তোরাঁয় পার্টি দিতে। আবার শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হলো, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দিয়ে ঘটা করে কিছু একটা করা হোক। শেষ পর্যন্ত দুপুরে শ্বশুরবাড়ির আর রাতে জামিলের ইচ্ছের জয় হলো।
এ সমস্যাটা বিয়ের পর হতেই পারে। তবে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটু বুদ্ধি করে ঠিকই সামলে নেওয়া যায় সব দিক। সে জন্য চাই দুজনের সমান সহযোগিতা।
আসলে বিয়ের পর একটি মেয়েকে ঘিরে যে বিপুল প্রত্যাশার বলয় তৈরি হয়, তাতে একান্ত নিজের বলে খুব কম বিষয়ই অবশিষ্ট থাকে। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ, উপলক্ষ বা অনুষ্ঠান সামনে চলে এলে এসব দায়বদ্ধতা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন স্বামী নিজেই একটি পক্ষ, শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদ বা আত্মীয়স্বজন একটা পক্ষ, মেয়েটির নিজের বাড়ির লোকজন বা তাঁর বন্ধুবান্ধবও আলাদা একেকটা পক্ষ হয়ে ওঠেন। এসব ক্ষেত্রে স্বামী যদি পুরো বিষয়টি বুঝতে পেরে স্ত্রীর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলেই আসলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। দুজনে মিলে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলে সঠিক উপায়টাই বের হওয়ার কথা। কিন্তু স্বামী তাঁর অধিকারের দাবি নিয়ে যদি সব দায়িত্ব মেয়েটির ওপর চাপিয়ে বসে থাকেন, তাহলেই বিপদ।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নকশার সুবন্ধু সমীপেষুর পরামর্শক সারা যাকের বললেন, এসব ক্ষেত্রে মেয়েটিকে বুদ্ধি খাটিয়ে সব কুল রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে, যৌথ পরিবারে থাকলে সামাজিকতা এবং সবার মনের ইচ্ছা পূরণ করে তার পরই মন দিতে হবে ব্যক্তিগত পরিকল্পনার দিকে। সারা দিন বাড়িতে কাটিয়ে সন্ধ্যা বা বিকেলের দিকে বাপের বাড়ি যাওয়া যেতে পারে। তবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকেও এ ক্ষেত্রে একটু উদার ও বিবেচক হওয়া দরকার। বাড়ির বউয়েরও একটা আলাদা জগৎ আছে, এটা তাঁদেরও মাথায় রাখা দরকার। সারা যাকের বলছেন, আজকালকার আধুনিক মেয়েরা এভাবে সব দিক রক্ষা করেই চলেন।
মনিকা’স বাঁধন-এর কর্ণধার ও পরামর্শক মনিকা পারভীন বললেন, মেয়েটির শাশুড়ির এসব ক্ষেত্রে চমৎকার ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। পুত্রবধূর সঙ্গে আলাপ করে তিনিই দিতে পারেন দারুণ সমাধান। বিশেষ দিনগুলোতে যদি ছেলের বউয়ের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবকে নিমন্ত্রণ করা যায়, তাহলে বাড়িতে অনুষ্ঠান বা উৎসব করার ক্ষেত্রে তাঁদেরও উৎসাহ বাড়বে। পাশাপাশি পারিবারিক সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রেও তা বড় ভূমিকা রাখবে।
সারা যাকেরও এ বিষয়ে একই কথা বললেন, কম বয়সীদের সঙ্গে যদি তাদের মতো করে নিয়মিত মেলামেশা করা যায়, তাহলে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। এর পরও ছেলে আর বউয়ের জন্য তাঁর পরামর্শ হলো: এক. বাড়ির প্রথাগুলোই আগে সারতে হবে। এরপর নিজেদেরটা। দুই. জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর ক্ষেত্রে রাত ১২টায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেক কাটা যেতে পারে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে উদ্যাপনের বিষয়টি তাতে পূর্ণতা পায়। তিন. পয়লা বৈশাখ বা ভালোবাসা দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে তো স্বামী-স্ত্রী মিলেই ঘোরাঘুরি হবে। তবে একবেলা বাড়ির সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করা উচিত।
মনিকা পারভীন এর সঙ্গে যোগ করলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরও বিরাট দায়িত্ব আছে। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলে বউয়ের পরামর্শটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। তাঁর সুবিধা-অসুবিধাগুলোও মাথায় রাখা দরকার। মুরব্বিরা পুরোনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে থাকলেই বরং এসব ক্ষেত্রে অনর্থক জটিলতার সৃষ্টি হয়। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতার বদলে আন্তরিকতার চর্চাই এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে বলে মত দিলেন তিনি।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক লোপা আহমেদ বিয়ে করেছেন পছন্দের মানুষকে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন সম্পর্কে আগে থেকেই জানাশোনা থাকায় বিয়ের পর যৌথ পরিবারে মানিয়ে নিতে অনেকটাই সহজ হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অবদানও কম নয়। লোপার অফিস এক দিন সকালে তো এক দিন বিকেলে। সপ্তাহে এক দিন আবার রাতের শিফটে। বাড়ির সব অনুষ্ঠানে এ কারণে সব সময় থাকাও যায় না। একবার তো রাত ১২টায় শাশুড়ির জন্মদিনের কেকই কাটা হলো না, কারণ ওই রাতের শিফট! লোপা বলছিলেন, সেদিন পয়লা বৈশাখে ভোর ছয়টা থেকে অফিস, অথচ বর শিহাবের ওই দিন ছুটি। কী আর করা, বেলা তিনটায় ছুটির পর দুজন মিলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, সন্ধ্যায় মা-বাবা আর রাতে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কাটিয়েছেন। সবাই মোটামুটি খুশি, সবাইকেই কিছুটা করে সময় দেওয়া গেছে। শাশুড়ি আর বরের সঙ্গে সুন্দর বোঝাপড়ার কারণেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করেন লোপা। আর সারা যাকের বললেন, যেকোনো পরিবারেই এ ধরনের সংহতিই কাম্য। বোঝাপড়া বা আন্তরিকতা না থাকলে সম্ভব নয় পরিপূর্ণ পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন, এমনকি একসঙ্গে যৌথ পরিবারে বসবাসও।
ছবিঃ কখনো হয়তো শুধু দুজনে মিলেই বিশেষ দিন পালন করতে ইচ্ছে হয়। নকশার আয়োজনে মডেল হয়েছেন দিহান ও তাঁর স্বামী
ফারহানা আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৯, ২০১১
Leave a Reply