সৈকতের আকাশে উড়ল এগারো টাইগার। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে উখিয়া উপজেলার পাথুরে সৈকত ইনানী। সৈকতের পূর্ব পাশে বিশাল পাহাড়, যা কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার বিস্তৃত। পাহাড়ের সামনে ১২০ কিলোমিটার লম্বা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র। এই ইনানী সৈকতে ৩ ও ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো দুই দিনব্যাপী ঘুড়ি উৎ সব। ঢাকার চারুশিল্পীদের সংগঠন ‘ছবির হাট’ এ উৎ সবের আয়োজন করে। এটি তাদের সপ্তম আয়োজন। এর আগে কক্সবাজার, ইনানী ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপ-সৈকতে ঘুড়ি উৎ সব হয়।
উৎ সবের প্রথম দিন। বিশাল জাতীয় পতাকা চারপাশ ঘিরে ধরে ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা…’ দেশাত্মবোধক গানটি গেয়ে ঘুড়িয়ালরা এগোতে থাকেন সৈকতের দিকে। প্রত্যেকের হাতে নানা রঙের ঘুড়ি। তারপর বালুচরে দাঁড়ানো ১১ শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হলো বাংলার ১১টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুড়ি। প্রথমে লাল রঙের একটি বাঘকে নানা কষ্টে আকাশে তোলা হলো। তারপর সাদা, নীল, হলুদ রঙের আরও ১০টি বাঘ একে একে উড়াল দিল আকাশে। বিশাল মুক্ত আকাশ ১১ বাঘের দখলে, তা কী করে হয়? বাঘের সঙ্গী হলো সামুদ্রিক প্রাণী হাঙর, ডলফিন, লবস্টার, জেলিফিগ, মৎ স্যকন্যা, শামুক, বনের অজগর, প্রজাপতি, ময়ূর, সূর্যমুখী, তরুণী, জলকন্যা, জাতীয় পতাকাসহ আরও কত কিছু। ভ্রমণে আসা বিপুলসংখ্যক পর্যটক বালুচরে দাঁড়িয়ে আকাশে নানা রং ছড়িয়ে উড়ে চলা প্রাণিকুলের লাফালাফি দেখে মুগ্ধ, মহাখুশি। একইভাবে দ্বিতীয় দিনও চলে মুক্ত আকাশে রঙের ছড়াছড়ি।
ছবির হাটের ৩৫ ঘুড়িয়াল (ঘুড়ি যাঁরা তৈরি করেন) আর ৪৫ জন উড়িয়াল (ঢাকা থেকে ঘুড়ি ওড়াতে আসা মানুষ) ছাড়াও স্থানীয় বহু শিশু-কিশোর, ভ্রমণে আসা পর্যটক উৎ সবে যোগ দিয়ে মনের মতো করে ঘুড়ি উড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন।
আয়োজকেরা জানান, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে উৎ সাহ দিতেই আকাশে সেই ১১ খেলোয়াড়কে বাঘ বানানো হলো। রশি দিয়ে বেঁধে নানা কৌশলে বশ মানিয়ে এই বাঘগুলোকে আকাশে তোলা হয়।
বালুচরে দাঁড়িয়ে একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুড়ি ওড়াচ্ছে ঢাকা গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র রোদ্দুর (১০)। রোদ্দুরের পরনে সাকিব আল হাসানের নাম লেখা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টি-শার্ট। তার পাশে আরেকটি বাঘের ঘুড়ি ধরে আছে সুপ্রভ (৮)।
রোদ্দুর বলে, ‘সাকিব আমার ফেবারিট। তাই সাকিবের নামে তৈরি বাঘ-ঘুড়ি ওড়াচ্ছি।’
ঘুড়িয়ালদের মধ্যে রয়েছেন ডেনমার্কের চারুশিল্পী স্টিফেন কার্লসন (৩০)। তিনি তৈরি করেন সামুদ্রিক শামুক-ঘুড়ি। বালুচরে দাঁড়িয়ে তিনি শামুক-ঘুড়িটি ওড়াচ্ছিলেন। স্টিফেন বলেন, ‘ছবির হাটের কর্মশালায় যোগ দিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি তৈরির কৌশল শিখে নিলাম। নিজের দেশে গিয়ে এসব কাজে লাগাব। আর বিশ্বের দীর্ঘতম এই সৈকতে ঘুড়ি ওড়াতে পেরে আরও বেশি ভালো লাগছে।’ ছবির হাটের সদস্য মেজবাহ য়াযাদ জানান, উৎ সবের আগে ঢাকায় উড়িয়ালদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা সম্পন্ন করা হয়। এখানে চারুশিল্পী স্টিফেনও যোগ দেন। এই কর্মশালায় ঘুড়ি তৈরির নানা কৌশল নিয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ওই কর্মশালায় যৌথভাবে তৈরি করা হয় ১১ বাঘসহ নানা ধরনের শতাধিক ঘুড়ি। এসব ঘুড়ি এখন সৈকতে ওড়ানো হচ্ছে।
ছবির হাটের আরেক সদস্য কার্টুনিস্ট বিপুল সাহা বলেন, ‘অন্যকিছুর মতো ঘুড়ির ঐতিহ্যও দেশ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের মুক্তমনে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নটাও। ঘুড়িটা বড় কথা নয়, আমরা চাই শিশুমনে স্বপ্ন বিকাশের পরিবেশ। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা বারবার ঘুড়ি উৎ সব করে চলেছি। সদস্যদের চাঁদার টাকায় চলে এই উৎ সব। তাই উৎ সবে মজাও অনেক।’
চারুশিল্পী কামরুজ্জমান স্বাধীন বলেন, ‘বিদেশি নয়, আমরা নিজস্ব স্বকীয়তায় নানা প্রজাতির ঘুড়ি তৈরি করেছি, যার সঙ্গে এ দেশের মানুষের ঐতিহ্যগত মিল রয়েছে।’
আয়োজকেরা জানান, ঘুড়ি ওড়ানোর পূর্বশর্ত হচ্ছে বাতাস। বাতাস ছাড়া ঘুড়ি ওড়ানো যায় না। এখানে মুক্ত আকাশ ও বাতাস দুটোই আছে। তাই উৎ সবের জন্য ইনানী সৈকতকে বারবার বেছে নেওয়া হয়।
আবদুল কুদ্দুস
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৯, ২০১১
Leave a Reply