ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংয়ে পরিচয় মেয়েটির সঙ্গে। সে ছিল ধর্মভীরু। একসময় নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয়। ধীরে ধীরে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি। আমার ভালোবাসার কথা তাকে বললে সে উল্টো ভালোবাসার খারাপ দিকগুলো তুলে ধরে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। আমি জানি, সেও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে; কিন্তু মা-বাবা ও পরিবার-পরিজনদের বিশ্বাস নষ্ট করে সে সম্পর্ক করতে চায় না। এভাবে আড়াই বছর আমাদের যোগাযোগ চলছে। আমি তাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। ইদানীং আমি রাতে ঘুমোতে পারছি না। যখন এসব চিন্তা মাথায় আসে, তখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তাকে ছাড়া পড়াশোনা, আড্ডা—কিছুই ভালো লাগে না। এককথায় আমি তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। সেও একবার বলে, তোমার পাশে আছি, কিছুদিন পর আবার এর বিপক্ষে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যা আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। আমি নিজের ওপর ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। আমি এখন কী করব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরামর্শ: মেয়েটির সঙ্গে কীভাবে নিয়মিত যোগাযোগ হয়েছে, তা ঠিক বোঝা গেল না। তোমরা কি সব সময় ফোনে কথা বলতে? মেয়েটির যদি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এতটাই আপত্তি থাকে, তাহলে তুমি তাকে ভালোবাসার কথা জানানোর পরও এত দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। মেয়েটি কি তোমাকে শুধু বন্ধু হিসেবে পেতে চায়? দুজন দুই রকম মনোভাব পোষণ করলে তো একটি অসম সম্পর্ক তৈরি হয়। আর এ ধরনের সম্পর্কের ফল খুব সুখকর হয় না। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটি কী চাইছে, তা সে নিজেই ভালো করে জানে না। আর তার এই বিভ্রান্তি তোমার মনেও অনেক অশান্তি সৃষ্টি করছে। আড়াই বছর ধরে সে তার নিজস্ব চাহিদা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও পরিবারের মনোভাব—এ সবকিছু নিয়ে শুধুই যুদ্ধ করে চলেছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। মেয়েটির এই সিদ্ধান্তহীনতা এবং তোমার প্রতি আবেগীয় নির্ভরশীলতা—দুজনের মনের ওপরই ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, কাউকে ভালোবাসার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে আমরা সারাক্ষণ সেই মানুষটির কথা ভেবে নিজেদের জীবনের দায়িত্ব, আনন্দ সবকিছু থেকে বিরত থাকব। প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য হচ্ছে প্রথমে নিজের মনের ও শরীরের সবটুকু যত্ন নেওয়া। তুমি নিজে ভালো থাকতে পারলে মেয়েটিকেও সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারবে যে, তার এই বিভ্রান্তিকর আচরণ কীভাবে দুটি জীবনের জন্য হুমকি তৈরি করছে। তাকে বলো, যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমাকে তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিতে। ওর সিদ্ধান্ত যদি তোমার জন্য নেতিবাচক হয়, তাহলে সেটি গ্রহণ করে নেওয়ার মতো মানসিক ক্ষমতা তুমি আগেই তৈরি করে নেবে। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া না করতে পারলে তা সারা জীবনের জন্যই অসুবিধা তৈরি করতে থাকে। মা-বাবা তো তোমার কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন, তাই না? আশা করি সে কথাটিও সব সময় মনে রেখে তাঁদের স্বপ্ন পূরণের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। শুভ কামনা রইল।
সমস্যা: আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই বললেই চলে। কারও সঙ্গে মিশতেও ভালো লাগে না। এসএসসিতে আমি মা-বাবা ও শিক্ষকদের আশানুরূপ ফল করতে পারিনি। এইচএসসি পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে, কিন্তু বই খুলতেই মন চায় না। এর জন্য আমার বাইরের বই পড়ার অভ্যাস দায়ী—এটা আমার মা-বাবার ধারণা। একসময় পত্রিকায় লেখালেখির অভ্যাস ছিল, কিন্তু বাবার কড়া নিষেধ থাকার কারণে আপাতত তা-ও স্থগিত রাখতে হয়েছে। পড়াশোনার বাইরের বই পড়তে আমার ভালো লাগে, এ জন্য বাসার সবার কাছেই আমাকে বকা শুনতে হয়। আমি কী করে অন্য বই পড়ার অভ্যাস কমাতে পারি এবং ফল খুব ভালো (!) করতে পারি? কারও বন্ধু হতে চাইলে কী করতে হয়?
নুরুন্নাহার শিল্পী
নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম।
পরামর্শ: এই বয়সে তোমার তেমন কোনো বন্ধু নেই, তা সত্যিই দুঃখজনক। সাধারণত এই বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা অনেক বেশি হওয়ার কথা। আর এ সময়ের আন্তরিক সম্পর্ক সারা জীবন মনের অনেকখানি জায়গা দখল করে থাকে। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিতে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতে পারলে আমাদের যে সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয়, তা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে চারপাশের মানুষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে খুব সাহায্য করে। তোমার যেহেতু সামাজিক জীবন তেমন নেই, সে কারণেই বইকে তুমি বন্ধু বানিয়ে নিয়েছ নিজের অজান্তেই। বিভিন্ন বই পড়ার মাধ্যমে তোমার মনের ক্ষুধা কিছুটা হলেও মিটে যায় এবং সময়ও ভালো কাটে। মা-বাবা তোমাকে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে কখনো উৎসাহ দিয়েছেন কি না, তা বুঝতে পারিনি, তা করলে কিন্তু খুব ভালো হতো। তাঁদের যেহেতু মনে হচ্ছে যে তুমি অনেক বেশি সময় ধরে বাইরের বই পড়ছ, তুমি নিজে চেষ্টা করে দেখো, অন্তত পরীক্ষা সামনে রয়েছে এ কথাটি মনে রেখে কষ্ট করে হলেও পড়ার বইয়ের প্রতি আরও মনোযোগী হতে পারো কি না; যেহেতু তোমার পড়ার অভ্যাস আছে, নিজেকে একটু বোঝাতে পারলেই তুমি কিছুদিনের জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অবশ্যই সময় দিতে পারবে। পরীক্ষায় কিছুটা ভালো ফল হলে তোমার নিজের ওপর আস্থা অনেক বেড়ে যাবে এবং সেই সঙ্গে মা-বাবাও খুশি হবেন। আমি তোমাকে অন্য বই পড়ার অভ্যাস কমানোর জন্য চেষ্টা করতে বলব না। কারণ, ভালো ভালো বই পড়লে যে অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার তৈরি হবে, তা তোমাকে সারা জীবন সুবিধা দেবে। বাইরের বই পড়ার অভ্যাস আজকাল শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না। অথচ এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং ইতিবাচক একটি শখ। আমি আশা করব, এইচএসসি পরীক্ষার পর তুমি আবার বিভিন্ন বই পড়বে এবং বাবাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি করবে। বাবাকে এটাও বলবে যে তিনি ভবিষ্যতে যাতে তোমাকে নিয়ে গর্বিত হতে পারেন, সেই চেষ্টা তোমার সব সময় থাকবে। তোমার প্রতিভার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটাতে হলে শুধু পাঠ্যবই যে যথেষ্ট নয়, তা যদি পরিবারের সদস্যদের বোঝাতে পারো, তাহলে খুব ভালো হয়। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি যদি কিছু সমমনা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারো, তাহলে সবচেয় ভালো হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৫, ২০১১
Leave a Reply