শুধু ক্রিকেট মাঠে নয়, যেকোনো বিজয়ে সবার আগে মনে পড়ে দেশের কথা। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা। মিরপুর স্টেডিয়ামে যেই না বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ডের শেষ উইকেটটি নিয়ে নিল, ভেসে এল মানুষের উল্লাস, ভুভুজেলার আওয়াজ। চারদিকেই এক ধ্বনি—‘বাংলাদেশ’। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল এক পতাকা নিয়ে রাস্তায় বেরোল আনন্দমিছিল। সেই রাতে ঢাকা কলেজ, টিএসসির সামনে একই চিত্র। আর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ওই ম্যাচের বিজয় এসেছে যেখান থেকে, সেই মিরপুর তো ভেসে গেছে মানুষের আনন্দে। সারা দেশই মাতোয়ারা বিজয়ের উৎসবে। আর এই উৎসব উদ্যাপনের প্রকাশ দেশ দিয়েই।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলার সময় গ্যালারিতে নানাভাবে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ। কারও হাতে বাঘের পুতুল, বাঘের ছবি, কারও মুখ লাল-সবুজে রাঙা, কারও মুখে যেন রং-তুলিতে আঁকা বাঘের প্রতিকৃতি। পোশাকে লাল-সবুজ মানেই বাংলাদেশের উপস্থিতি।
পয়লা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তাতে বড় বড় মুখোশে উঠে আসে আমাদের চিরায়ত কৃষ্টি। পেঁচা, ময়ূর, হাতি, ঘোড়া, মাটির পুতুল কত কত অবয়ব! বৈশাখ ঘিরে যে মানুষের আনন্দ-উৎসব, তাতে কমবেশি সবার পরনেই বৈশাখের রঙে-ঢঙে তৈরি পোশাক। একুশে ফেব্রুয়ারি পোশাকে ভাষা শহীদদের স্মরণে দেখা যায় সাদা-কালোর ব্যবহার। পোশাকে, দেয়ালে বর্ণমালার চিত্র, শহীদ মিনারের বেদিতে বা পিচঢালা পথের আলপনায় ফুটে ওঠে শ্রদ্ধা আর মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার গর্ব। ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বরের পোশাকে চলে আসে লাল-সবুজ।
গত বছরের ১ জুন। মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট জয় করে ফিরে এলেন ঢাকায়। তাঁর পরনে লাল-সবুজের টি-শার্ট, মাথায় লাল-সবুজ ব্যান্ডানা। তাঁকে যাঁরা স্বাগত জানাতে গেছেন বিমানবন্দরে, তাঁদের সঙ্গেও বাংলাদেশ, বাংলাদেশের পতাকা।
২৩ মে ভোরে যখন মুসা ইব্রাহীম বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় ওঠেন, তখন তিনি প্রথমেই ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা। ‘বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল আমাদের। তাই যখন সে স্বপ্ন সফল হলো, তখন প্রথমেই দেশকে তুলে ধরার কথা মনে হয়েছে। আর পর্বতারোহীদের মধ্যে একটা প্রচলিত বিষয় হলো—যখনই কোনো চূড়া জয় করা হয়, তখন নিজ নিজ দেশের পতাকা ওড়ান তাঁরা। পতাকাটা দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।’
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এই মৌসুমে নিজের বাসায় ৫০ ফুট দীর্ঘ পতাকা ঝুলিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। বললেন, ‘আমার কাছে যেকোনো বিজয় বা আনন্দ উদ্যাপনে দেশকে তুলে ধরার ব্যাপারটা খুবই ইতিবাচক মনে হয়। তবে পতাকা টানানোর বেলায় কিছু নিয়ম থাকায় বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমাদের দেশে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পতাকা যেমন দেখা যায়, ক্রিকেটের সময় বাংলাদেশের পতাকা তেমন উড়তে দেখা যায় না। তার পরও মানুষ লাল-সবুজ রং নানাভাবে ব্যবহার করে দেশকে তুলে ধরে। দেশের যেকোনো গৌরব মানুষ উদ্যাপন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দেশের প্রতি টান সবারই আছে, সেটার প্রকাশ পায় উপলক্ষ ধরে। যা খুব উৎসাহব্যঞ্জক।’
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দুই শিক্ষার্থী নাজিয়া চৌধুরী ও সামিন রিয়াসাত জার্মানির ব্রেমেনে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন। পদক জেতার পর তাঁদের পরনে দেখা যায় লাল-সবুজের টি-শার্ট আর হাতে পতাকা। মানে বিজয়ের আনন্দে বাংলাদেশকে উদ্যাপন। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ বিষয়টি খুব বেশি দেখা যায়, দেশকে তুলে ধরা—বিজয়ের সঙ্গে উদ্যাপনের আনন্দে। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে এ ব্যাপারটি বেশ চোখে পড়ছে।
পতাকার রং, উৎসবের রং, লোকজ শিল্পকলার মোটিফ, অতি পরিচিত চিরায়ত কোনো প্রতীক দিয়ে নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার বড় একটা মাধ্যম হলো পোশাক। ‘গত ১০ বছরে দেশে ফ্যাশনে একটা পরিবর্তন এসেছে। ফ্যাশনে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। যার প্রমাণ আছে পত্রপত্রিকায়। বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে ফ্যাশনে স্বদেশি চেতনার নবজাগরণ ঘটেছে।’ বললেন ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান। তিনি আরও যোগ করেন, ‘সবাই নিজের দেশকে ভালোবাসে। দেশকে সবাই উপস্থাপন করতে চায়। আগে অন্য দেশের নকশা অনুসরণ করা হতো। এখন ঈদের সময় দেখা যায়, কমবেশি সব ফ্যাশন হাউস চেষ্টা করে একটা বিষয় বা থিম ধরে কাজ করতে। ফলে নিজের দেশকে তুলে ধরার মাধ্যমও পাচ্ছে ক্রেতারা। ফ্যাশনের দিক থেকে বলা যায়, দু-তিন বছর ধরে পয়লা বৈশাখে এখন ঈদের মতোই চাহিদা থাকে পোশাকের। ফ্যাশনে দেশি চেতনায় এই যে পরিবর্তন এসেছে, তার সুদৃঢ় ভিত গড়ার সময় এখনই।’
দেখা যাচ্ছে, যেকোনো উৎসবে, আয়োজনে দেশকে তুলে ধরার এই যে ধারা, তা সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম থেকেই উৎসারিত। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা যেমন বিজয়ের বা আনন্দের মুহূর্তে দেশকে তুলে ধরছে, তেমনি নিজের দেশকে সঙ্গে নিয়েই সেই মুহূর্তকে উদ্যাপন করছে সাধারণ মানুষ।
মুসা ইব্রাহীম বললেন, ‘অন্য দেশে গেলে দেখি সেখানকার নাগরিকেরা তাদের দেশকে কীভাবে তুলে ধরছে। আমাদের এখানেও দেশকে তুলে ধরার যে দৃশ্য দেখা যায়, তা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে শুধু আনন্দ-উল্লাসে লাল-সবুজকে তুলে ধরাই শেষ কথা নয়। প্রতিটি কাজে অর্থাৎ দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে যেন দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটানো হয়।’
কখনো পতাকার রঙে পোশাক, কখনো মুখে লাল-সবুজ বা একতারা আঁকা ছবি, কখনো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো সাজসজ্জা, টি-শার্টে পট, সরা বা রিকশাচিত্র—নিজের দেশকে এভাবেই তুলে ধরা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততায়। যেন বলে দেওয়া হচ্ছে—
শাবাশ বাংলাদেশ!
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
পল্লব মোহাইমেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০১, ২০১১
Leave a Reply