ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ৪৮ বছর। স্ত্রী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত। দুই মেয়েসন্তান আছে। মায়ের সঙ্গে থাকে। আমি সন্তানদের সব খরচ বহন করি। আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি, যার বয়স ২৮ এবং অবিবাহিত। সে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমার বয়স বেশি হওয়ায় সে আমাকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে। আমাদের বিয়ে হলে বয়স বেশি হওয়ার জন্য কোনো সমস্যা হবে কি? আমরা খুবই চিন্তিত।
নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: মেয়েটি কি শুধু আপনার বয়সের কারণেই আপনাকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে, নাকি অন্যান্য কারণ, যেমন—দুজনের ব্যক্তিত্বের অসামঞ্জস্যতার জন্যও আপত্তি জানাচ্ছে? ২০ বছরের পার্থক্য আসলেই একটি বিশাল পার্থক্য। তবে আপনাদের সম্পর্ক যদি খুব আন্তরিক হয় এবং দুজনের মধ্যে অনেক ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং ভালো বোঝাপড়া থাকে, তাহলে তো অসুবিধা নেই। মেয়েটির সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করুন, তার ভয়ের পেছনে কী কী কারণ কাজ করছে। যদি সে সরাসরি সেগুলো বলে, তবে সেই ব্যাপারে আপনার কিছু করণীয় আছে কি না, তা-ও নিজে আগে ভালোভাবে বুঝে তারপর ওকে আশ্বস্ত করবেন। আপনার আগের স্ত্রী কী কারণে আপনাকে তালাক দিয়েছে, সে বিষয়গুলো খুব সততার সঙ্গে মেয়েটিকে খুলে বলুন। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো আন্তরিকভাবে স্বীকার করে নিয়ে আমাদের সব সময়ের প্রচেষ্টা থাকা দরকার, সে সমস্ত জায়গায় উন্নয়ন ঘটানো। কোনো একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে বুঝতে হবে, দুই পক্ষই সেখানে সচেতন বা অবচেতনভাবে কিছু অবদান রেখেছে। আপনি যদি আগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার নেতিবাচক অবদানগুলো নিয়ে কিছুটা হলেও স্পষ্ট হতে পারেন, তাহলে আরেকটি জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর আগে নিজের সেই নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কাজ করতে শুরু করুন। যেহেতু আপনার দুটি সন্তান আছে এবং তাদের প্রতি বিচ্ছেদের পরও আপনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে, আপনাকেও সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে চলতে হবে। আপনার সন্তানদের শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, আপনার স্নেহ-ভালোবাসা এবং তাদের জীবনের নির্দেশনাও আপনাকে সব সময় দিতে হবে। আপনার ছোট্ট চিঠি পড়ে ঠিক বোঝা গেল না, আপনি সব কটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে খুব ভালোভাবে চিন্তা করেছেন কি না। দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে এবং কারও আগের বিয়েতে সন্তান থাকলে অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই কথাগুলো লিখে আমি আপনাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাইছি না। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনি যেন দ্বিতীয়বার কী কী সমস্যা হতে পারে, সে সম্পর্কে আগে থেকেই আত্মসচেতন হয়ে তারপর বিয়ের মতো একটি বড় পদক্ষেপ নিতে পারেন।
সমস্যা: আমি বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান। কিন্তু এ আদরের মধ্যে রয়েছে কঠোরতম চাপ, যা আমাকে প্রতিনিয়ত বিষণ্ন করে তোলে। আমি খুবই চঞ্চল, বেশি কথা বলার অভ্যাস আছে কিন্তু খুবই বন্ধুপ্রিয়। কারও সঙ্গে প্রেম করি না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। আমার বাবা-মা তা পছন্দ করেন না। তাই তাঁদের খুশি করার জন্য ১০ বছরের পরিচিত আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। আমি মনে করেছিলাম, সে আমার সমবয়সী হওয়ায় তাঁরা তাকে পছন্দ করেন না। পরে আমার বয়সের চেয়ে অনেক বড় এক ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। তার সঙ্গে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু আমি তা আমার বাবা-মাকে বোঝাতে পারছি না। তাঁরা আমাকে অবিশ্বাস করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
পরামর্শ: তোমার বয়সটা উল্লেখ করা খুব প্রয়োজন ছিল। যদি বয়ঃসন্ধিতে থাকো, তাহলে অভিভাবকদের বুঝতে হবে, এই বয়সে বন্ধুপ্রিয়তা বেশ বেড়ে যায়। এই সময় বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার প্রবণতাও তৈরি হয়। বিশেষ করে, যারা নিজের মতামত নিয়ে সংশয় বা দ্বন্দ্বে ভোগে, তারা আরও বেশি প্রভাবিত হয়। অনেক মা-বাবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগেন বলে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে গিয়ে তাঁদের সন্তানদের সমবয়সীদের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলেন। তবে এটাও ঠিক, বাবা-মায়ের তাঁদের সন্তানদের বন্ধুদের সম্পর্কে খোঁজ রাখাটা জরুরি। বন্ধু না থাকলে সন্তানেরা খুব একাকিত্বে ভোগে এবং তাদের সামাজিক দক্ষতাগুলো তৈরি হয় না বলে তারা পরবর্তী সময়ে অনেক অসুবিধায় পড়ে। আমাদের সমাজের অভিভাবকরা সন্তানের মনো-সামাজিক বিকাশের প্রতি খুব কমই লক্ষ করেন। তোমাকে ১০ বছরের পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে কী কারণে যোগাযোগ বন্ধ করতে হয়েছে, তা লেখোনি। তুমি কি পড়ালেখা বাদ দিয়ে তার সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতে? বাবা-মা তোমাকে কী কারণে অবিশ্বাস করছেন, তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। তুমি যদি নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকো যে তুমি কোনো অন্যায় করছ না, তাহলে বাবা-মাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে বলো তোমাকে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে হলে অন্তত কিছুটা সময় ভালো বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। তুমি তোমার বন্ধুদের যদি বাড়িতে ডেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, তাহলে খুব ভালো হয়। তাঁরা তখন আশ্বস্ত হবেন, তুমি সৎসঙ্গেই রয়েছ। আমাদের জীবনে অন্তত এক-দুজন ভালো বন্ধু থাকলে জীবনে আনন্দ লাভ এবং সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে অনেক সুবিধা হয়—এ কথাটাও মা-বাবাকে বলবে, কেমন?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১১
Leave a Reply