তৌসিফের বয়স সবে তিন। পুরো বাক্যটা গুছিয়ে না বলতে পারলেও মনের ভাবটা ঠিকই প্রকাশ করে একটির সঙ্গে আরেকটি শব্দের জোড়া দিয়ে। দেশের মাটিতে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। তাই তৌসিফকে কিনে দেওয়া হয়েছে লাল-সবুজ রঙের জার্সি। বোঝানো হয়েছে, লাল-সবুজ হলো জাতীয় পতাকার রং। কেউ যদি প্রশ্ন করে জাতীয় পতাকার রং কী? নিমিষেই তৌসিফ দেখিয়ে দেয় নিজের গায়ের জার্সিটা। তৌসিফের মা শামসুন্নাহার বলেন, আমি একটু কৌশল করেই ওকে শিখিয়ে দিয়েছি কোনটা জাতীয় পতাকা। আবার মাথার টুপিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি দেখিয়ে শিখিয়েছি এটা জাতীয় পশু। শুধু কি তাই! ছোট্ট কোমল হাতে যখনই কাঠের ব্যাটটা তুলে নেয়, তখনই প্রতিটি বলের হিসাব করতে থাকে। আর এভাবেই গুনতে শিখে গেছে তৌসিফ।
এদিকে একই বয়সী ফারিহার পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত তার মা-বাবা। তবে দুপুরে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঘুমপাড়ানি গান শুনে শুনে ফারিহা কখনো কখনো আপন মনেই সেই গান গুনগুন করতে থাকে। আবার বাবার সঙ্গে সিঁড়ি ভাঙতে গেলে প্রতিটি সিঁড়ি গুনে গুনে পা ফেলে সে।
ছবি আঁকা খুবই পছন্দ করে অবনী। পেনসিল, কাগজ আর রংতুলি ছাপিয়ে ঘরের দেয়াল এখন তার ক্যানভাস। সারা দেয়ালজুড়েই চলে আঁকিবুকি। মনের খেয়ালে এঁকে যাওয়া এসব অর্থহীন আঁকিবুকি কখনো কখনো পেয়ে যায় কোনো আকার। অবনীর মা সোনিয়া বলেন, ‘আমি ওকে কখনো নিষেধ করি না। আঁকতে আঁকতে এখন অনেক কিছু শিখে ফেলেছে অবনী।’
শিশুর পড়াশোনার শুরুটা কেমন হবে, এটা নিয়েই মা-বাবার চিন্তার শেষ নেই। কেননা কোমলমতি এসব শিশুকে বেশি চাপ দিলে তার সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই পড়াশোনার শুরুটা এমনভাবে করতে হবে যেন শিশু বুঝতে না পারে তাকে জোর করে কিছু শেখানো হচ্ছে।
সানিডেল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহম্মেদ বলেন, মূলত বাড়ি থেকে শুরু হয় একটি বাচ্চার শিক্ষাজীবন। অনেক মা-বাবা মনে করেন, স্কুলই বাচ্চাকে সবকিছু শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবে। তাই হয়তো শিশুকে তেমন কিছুই শেখানো হয় না বাড়িতে। আবার এর বিপরীত চিত্রটিও দেখা যায়। কোনো কোনো মা-বাবা অতি সচেতন হয়ে স্কুলে পাঠানোর আগেই সন্তানের ওপর বেশি চাপ দিয়ে থাকেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হয়তো বই-খাতা দিয়ে বসিয়ে দেন বাচ্চাকে। তবে এই দুই পদ্ধতির কোনোটিই ভালো নয় শিশুর জন্য। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর আগে শিক্ষাটা দিতে হবে ঘর থেকে। তবে তা চাপ দিয়ে নয়। মা-বাবার উচিত শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া এবং এই সময়ের মধ্যেই মৌলিক কিছু শেখানো।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশু বর্ধন ও পরিচর্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোরশেদা বেগম বলেন, শিশুর মনের ওপর চাপ দিয়ে না শিখিয়ে বরং খেতে, ঘুমাতে বা হাঁটতে চলতে ছড়া, গান বা নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
শিশুর মানসিকতা বোঝাটা জরুরি বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যক্ষ ঝুনু শামসুন নাহার। তিনি বলেন, শিশুকে যদি খেলার ছলে শেখানো যায়, তবে তা বেশি কাজ দেয় এবং সেই শেখাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর শিশুকে উৎ সাহ দেওয়ার জন্য তার প্রতিটি কাজের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে পড়াশোনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের বর্ণিল উপহার।
চলছে অমর একুশে বইমেলা। তাই আর দেরি কেন, এই মাসেই হতে পারে আপনার শিশুর হাতেখড়ি। বইমেলার শিশু চত্বরে পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকমের শিশুতোষ বই। কোনোটা হয়তো রূপকথার, কোনোটা ছড়ার বা গল্পের, কোনোটা আবার বিজ্ঞানবিষয়ক, কোনোটা আবার কেবলই ছবি আঁকার বই। এই বইগুলো শিশু পড়তে না পারলেও মা-বাবা শিশুকে পড়ে শোনালে সে অনেক কিছু শিখে নেবে। এতে শিশুর কল্পনাশক্তি হবে বিকশিত। শুধু কি বই? ছড়া, গানের সিডি আর রংবেরঙের কাঠের তৈরি নানা বর্ণ আর সংখ্যার খেলনাও পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায়।
শিশুতোষ বই আর উদ্ভাবনমূলক খেলনার প্রতিষ্ঠান ‘ছোট্ট আমরা শিশু’র ব্যবস্থাপক পরিচালক শরিফ হাসান খন্দকার বলেন, শিশুদের হাতেখড়িটা যেন আনন্দঘনভাবে হয়, আমরা সেই চেষ্টাই করে থাকি। অনেক শিশু পড়তে পারে না; কিন্তু ছবি দেখে বা রঙিন খেলনা দেখে শিখে ফেলে কোন জিনিসটা কী বা কেমন। আর এই শেখাটা হয় দীর্ঘস্থায়ী।
শারমিন নাহার
মডেল: রাসেল ও তাঁর মেয়ে শামায়লা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১১
Leave a Reply