অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
ওষুধের অপব্যবহার, অবৈধ ব্যবসা, মাদক-এসব প্রসঙ্গ নিয়ে ২৬ জুন পালিত হতে যাচ্ছে মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। ড্রাগ অ্যাবিউজ ও ইলিসিট ট্রাফিকিংয়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস পালনের একটি সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এবং ২৬ জুন দিবসটি নির্ধারিত হয়।
মাদকের অপব্যবহারমুক্ত আন্তর্জাতিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করার জন্য এবং এ ব্যাপারে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ডাক দিয়ে দিবসটি পালন করা হবে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন, ‘নিষিদ্ধ ওষুধ প্রাণ হরণ করছে অসংখ্য মানুষের; সমাজকে করছে ধ্বংস। এসব ওষুধের অবৈধ ব্যবসা এবং এর ফলাফল আন্তর্জাতিক সমাজের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে।’
১৯৯৮ সালের ৮ থেকে ১০ জুন নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি বিশেষ অধিবেশনে বিশ্বের নেতারা একত্র হয়ে ২০০৮ সালের মধ্যে বিশ্বে এ ধরনের ওষুধের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) ওষুধবিরোধী অভিযান এ দিবসের ্লোগান দিয়েছে-‘ডু ড্রাগস কন্ট্রোল ইওর লাইফ? ইওর লাইফ, ইওর কমিউনিটি। নো প্লেস ফর ড্রাগস।’ অর্থাৎ ‘ওষুধ কি আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে? আমাদের জীবনে, আমাদের লোকসমাজে ওষুধের (অপব্যবহারের) কোনো স্থান নেই।’ এ স্লোগানটি তিন বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং ড্রাগ কনট্রোলের বিভিন্ন দিকের ওপর দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে-
২০০৭ সালে ওষুধের অপব্যবহার ছিল লক্ষ করার বিষয়। ২০০৮ সালে ওষুধ চাষ ও উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্থির করা হচ্ছে। মাদকের অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ অভিযানের উদ্দেশ্য-নিষিদ্ধ ওষুধ আমাদের সমাজে যেসব সমস্যার সৃষ্টি করছে, এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। নিষিদ্ধ ওষুধ ও মাদক ব্যক্তিবিশেষে মানুষের মন ও শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে; এসব মাদকের চাষ নিয়ন্ত্রণ করে চাষিদের এবং অবৈধ ব্যবসা ও অপরাধ সমাজকে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ফেলে।
এ অভিযানের লক্ষ্য হলো-এই অবৈধ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে জনমত তৈরি করা, একে প্রতিহত করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
ইউএনওডিসি যে মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য বলছে তা হলো-এমকেটেমাইন-জাতীয় উত্তেজক দ্রব্য (এটিএস), কোকা বা কোকেন, গাঁজা, হ্যালুসিনোজেনস, আফিম-জাতীয় ওষুধ ও ঘুমের ওষুধ।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে ২০০ মিলিয়ন মানুষ এ ধরনের মাদক ব্যবহার করছে। ক্যালারিস বা গাঁজা, হাশিশ, টিএইচসি ব্যবহার করছে ১৬২ মিলিয়ন মানুষ। এটিএস-এমফেটামাইন, মেথএমফেটামাইন, ইকটেসি, মেথক্যাথিনন ব্যবহার করছে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ। আনুমানিক ১৬ মিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করছে আফিম-জাতীয় দ্রব্য-আফিম, মরফিন, হেরোইন, সিনথেটিক অপিয়েটস। ১৩ মিলিয়ন মানুষ কোকেনে আসক্ত।
পশ্চিম ইউরোপে কোকেনের ব্যবহার উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বের সর্বত্র গাঁজার উৎপাদন ও ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। গাঁজা সেবনে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ে, প্রকৃতপক্ষে এ প্রভাব আরও বেশি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতিবছর দেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হচ্ছে। মাদকের অবৈধ আমদানিকারকদের সংখ্যাও প্রতিদিন বাড়ছে। এমন অভিযোগও রয়েছে যে কোনো কোনো ওষুধের বৈধ আমদানিকারকেরা বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে অবৈধভাবে দেশে আনছেন মাদক। হেরোইন, মদ, ইয়াবা-এ ধরনের বিভিন্ন মাদক বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আমদানি করা হচ্ছে। দেশের নানা সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে এসব মাদক। মিয়ানমার থেকে বেশি আসছে ইয়াবা। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তকে ব্যবহার করছেন ব্যবসায়ীরা, যাঁরা অবৈধ ব্যবসা করছেন। ফেনসিডিল বা ডাইলের বাজারও এ দেশে বিশাল। এদের নিষিদ্ধ ওষুধ ও মাদকদ্রব্য পাচারের কৌশল এত সূক্ষ্ম যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও এগুলো প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টানো এবং আন্তর্জাতিক একটি শক্তিশালী চক্রের যোগসাজশে এ অবৈধ পাচার বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাদকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে স্বাস্থ্যসমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তরুণসমাজ হচ্ছে এর মূল শিকার। শরীর ও মনের ওপর এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, যা প্রভাব ফেলছে ব্যক্তি ও সমাজের ওপর। সমাজে চাপ, অপরাধ, দারিদ্র্য, ঘর ও সমাজে সহিংসতা এবং নানা ধরনের রোগ (নেশার ওষুধ যারা শিরার মধ্যে নেয়, তাদের মধ্যে এইচআইভি/এইডস, হেপাটাইটিস) বাড়ছে মাদক ব্যবহারের কারণে। এ জন্য মাদকের ব্যবহার ও অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে; এর কুপ্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে। সরকার ও জনগণ একত্রে একে প্রতিহত করতে হবে। একটি মাদকমুক্ত সমাজের জন্য লড়াই করে যেতে হবে আমাদের।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৫, ২০০৮
Leave a Reply