ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি খুবই আবেগপ্রবণ এবং মেয়েলি স্বভাবের। আমি অবসেশনে ভুগছি (এ জন্য সেরোলাক্স, পারকিলিন ও বর্তমানে এনজেনটা খাচ্ছি)। সব সময় মনে হয়েছে, একজন ভালো বন্ধু না থাকলে বাঁচতেই পারব না। অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়াতে নিজের মেয়েলি স্বভাবকে দায়ী মনে হয়। আমি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করি। তাদের কাছে ভালো ব্যবহার না পেলে কষ্ট হয়। যদি বন্ধুত্ব ভেঙে যায়—এই ভয়ে কিছু বলতেও সাহস করি না। ভাবি, কেন সে আমাকে বোঝে না? তাকে ছাড়া তো আমি মরেই যাব। ওকে হারানোর ভয় কাজ করে। পড়তে পারি না। ও একটু ভালো আচরণ করলে চোখে জল এসে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক,
শেরপুর।
পরামর্শ: তুমি কবে থেকে ওষুধগুলো খাচ্ছ, তা জানাওনি। অবসেশন থেকে বিষণ্নতা তৈরি হয় বলে ওষুধগুলো তোমাকে সাহায্য করছে ঠিক, তবে শুধু রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হতে হয়। আমার অনুরোধ থাকবে, প্রতি মাসে একবার অন্তত ঢাকায় এসে তুমি মেডিকেল চিকিৎসার পাশাপাশি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নাও। এই সাহায্যগুলো কোথায় পাবে, তা আগের সংখ্যাগুলোতে আমার দেওয়া উত্তরের মাধ্যমে জানতে পারবে। এত অল্প বয়স থেকেই যদি তুমি ক্রমাগত ওষুধ খেতে থাক, তাহলে পরে অসুবিধায় পড়তে পারো। তুমি লিখেছ, তোমার স্বভাব মেয়েলি। এটা বলতে তুমি ঠিক কী বুঝিয়েছ তা পরিষ্কার হয়নি। তুমি কি একজন ছেলে হয়েও আবেগপ্রবণ হতে পারো না? নিশ্চয়ই নিজের দুঃখ প্রকাশ করার অধিকার তোমার রয়েছে এবং ‘মেয়েরাই শুধু দুঃখ প্রকাশ করবে, ছেলেরা কখনোই কাঁদবে না’—এই বিশ্বাসটি সমাজ আরোপিত। এ কারণে ছেলেরা জোর করে কান্না বা দুঃখ প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে বলে বেশি বয়সে নানা রকম শারীরিক অসুস্থতার শিকার হয়। তবে ছেলে-মেয়ে সবারই বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের চিন্তাধারা এবং সব ধরনের নেতিবাচক আবেগগুলোর ওপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে চিন্তাধারায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সাহায্য পাওয়া সম্ভব। এতে করে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়নও ঘটে থাকে।
তোমার মনোসামাজিক বিকাশের ওপর কিন্তু শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলো অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে। কাজেই বর্তমানের মানসিক অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করা একটুও ঠিক হবে না। বন্ধুদের ওপর এতটা আবেগীয় নির্ভরশীলতা থেকে তোমাকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা কারও সঙ্গ না পেলে বাঁচব না বা বন্ধুত্ব ভাঙার ভয়ে মনের কথাগুলো বলব না—এই বিশ্বাসগুলো নিয়ে চললেও অনেক অসুবিধা হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, তুমি তোমার অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলো যে, তোমার এই মুহূর্তে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং সেবা খুব প্রয়োজন।
সমস্যা: আমার সঙ্গে প্রায় তিন বছর ধরে একটা ছেলের সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্কটা কয়েক মাস ধরে খুব খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের পাঁচ-ছয়বার দেখা হয়েছে, কিন্তু কখনো ও নিজে থেকে আসেনি। আমার কথায় এসেছে বা আমি ঢাকা গেলে দেখা হয়েছে। এখন প্রায়ই ঝগড়া হচ্ছে। প্রতিদিন কথা কাটাকাটি, রাগারাগি হয়।
আমি যা পছন্দ করি না বা যা করলে রাগ হই, সেটা বারবার করে। আমার রাগ বেশি। রেগে গেলে কথা বলতে পারি না, খুব শ্বাসকষ্ট হয়, মাথা ঘোরে। ওকে অনেকবার বুঝিয়েছি। বোঝালে কয়েক দিন ঠিক থাকে, পরে আবার একই কাজ করে। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি আর কোনো দিনই কথা বলব না। কিন্তু তখন ও অনেকবার ফোন দেয়। ও বলে, ওর পরিবারে অনেক সমস্যা, তাই এত কিছু মনে থাকে না। আমি জানি ওর সমস্যা আছে, তার পরও রাগ লাগে। ও কখনো বিয়ের কথা বলে না। আমি বললে এড়িয়ে যায়। বলে যে আগে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হবে, তারপর। কিন্তু সবার মনেই তো ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা থাকে, তাই না? আমিও এখন বিয়ে করব না, তবে ভাবতে ইচ্ছা করে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে কি না। আমার পরীক্ষা চলছে, কিন্তু আমি পড়তে পারছি না, অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: এভাবে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগলে তো তোমার পক্ষে লেখাপড়া করা সম্ভব নয়। একটি প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক সুন্দরভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য দুজনেরই আবেগীয় পরিপক্বতা জরুরি। তুমি যে অন্য একজনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের রাগ কমাতে চাইছ এবং তোমার আবেগের দায় অন্যের ওপরে দিতে চাইছ, সেটি কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। অন্য একটি মানুষের আচরণে বা মন্তব্যে আমি কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ব তা কিন্তু পুরোপুরিভাবে আমার নিজস্ব চিন্তাধারার ওপর নির্ভরশীল। জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে আমরা কীভাবে বিশ্লেষণ করব, তা নির্ভর করে আমাদের প্রত্যক্ষণের ধরনের ওপর। কাজেই প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকেই নিজেদের চিন্তাধারা, আবেগ এবং আচরণ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আর ‘রাগ’ নামের আবেগটি সবার মধ্যে কমবেশি উপস্থিত থাকলেও এটির আধিক্য একেবারেই কাম্য নয়। তুমি যে রেগে গেলে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ছ, এটি তোমার স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি যেকোনো সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া এবং তৈরি করার ক্ষেত্রেও অনেক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। কারণ, বেশি রেগে গেলে আমাদের কথাবার্তার ওপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বলে অন্যকে আমরা খুব আঘাত করে ফেলি।
এরপর যতই দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাই না কেন, কথাগুলো কিন্তু অন্যের মনের মধ্যে থেকে যায়। তুমি ভেবে দেখতে পারো, তোমার অতিরিক্ত রাগের কারণে কীভাবে ছেলেটিকে আঘাত করে চলেছ। শুধু ওকে আঘাত করাই নয়, এরপর কিন্তু তুমি নিজেও অপরাধবোধে ভুগছ। কাজেই ছেলেটিকে তোমার আচরণের জন্য দায়ী না করে নিজের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনো। নিজেকে যদি যথেষ্ট ভালোবাসতে এবং গুরুত্ব দিতে পারো, তাহলে কিছুটা উপকার পাবে। তবে রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য তুমি যদি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং সেবা নিতে পারো তাহলে খুব ভালো হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৫, ২০১০
Leave a Reply