ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: শৈশব থেকেই আমি বেশ দুরন্ত, লেখাপড়ায় একেবারে মন্দ ছিলাম না। পরীক্ষার ফলাফলও ভালো হতো। এভাবে একে একে সব অতিক্রম করে এসএসসি পাস করলাম ২০০২ সালে। পড়ালেখায় পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতাম না, তাই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৩ দশমিক ৩৮ পেয়েও এইচএসসিতে আর বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম না। বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলে বাণিজ্যে ভর্তি হলাম। কিন্তু বাসায় তা মেনে নিল না, আমাকে বিজ্ঞান পড়তেই হবে। আমি বললাম, আমাকে দিয়ে হবে না। আমি খেলাপাগল, পড়ায় খুব কম সময় দিই। সবকিছু মেনে নিয়ে দুবার পরীক্ষা দিয়েও ফলাফল শূন্য। আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানতে তো পারিনি এবং হতাশা বেড়েছে, তাই আর পড়ায় মন বসেনি। এদিকে লজ্জায় মুখ দেখানোর জো নেই। এতে করে নিজের অযোগ্যতার ওপর দারুণ ঘৃণা জন্মায় আমার।
অবশেষে পড়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে আবার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হব ভেবেছি—অবশ্যই বিষয় বদলে। তবে আমার মনে দুবার ব্যর্থতার প্রভাব রয়ে গেছে, নিজেকে খুব ঘেন্না হয়, এ জন্য কোনো সময় বিষণ্নতায় ভুগি। নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেওয়ায় একাকিত্বও ভর করেছে, মনে হয় আমি যেন কিছুই করতে পারব না।
ভেবেছি, যেভাবেই হোক পাস করে ঢাকায় চলে যাব। আমার দুটি বোন আছে, ভাই নেই। নতুন করে জীবন শুরু করব দূরে গিয়ে।
আমাকে এসব বিষয়ে পরামর্শ দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
তানজীল শাহরিয়ার আলী
ঠিকানা পাওয়া যায়নি
পরামর্শ: সুন্দর চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমার সবচেয়ে যেটি ভালো লেগেছে তা হচ্ছে, তুমি খুব অল্প বয়সেই নিজের প্রবণতা, ক্ষমতা ও আগ্রহগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পেরেছিলে। দুর্ভাগ্যবশত পরিবারের সদস্যরা তোমার বিচার-বুদ্ধির ওপরে গুরুত্ব দিতে পারেননি। তাঁরা তোমার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিজ্ঞান পড়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে তুমি কিন্তু এখন খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছ কী কী কারণে পরীক্ষায় সাফল্য আসেনি। এ ধরনের উপলব্ধি ও সচেতনতাই আমাদের জীবনের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। এখন যা করা প্রয়োজন তা হলো—এর সবটুকু দায়ভার নিজের কাঁধে বা পরিবারের ওপরে না দিয়ে মাঝামাঝি একটা জায়গায় অবস্থান করা। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে তুমি একটা ভুল হিসেবে দেখতে পারো। অর্থাৎ পরিবার ভুল করেছে তোমার ব্যক্তিত্বের ধরনটিকে ঠিকমতো বুঝতে না পেরে এবং তুমিও নিজের সবটুকু প্রচেষ্টা ঢেলে দাওনি প্রথম থেকেই, একটা অনীহা কাজ করেছে বলে। তুমি অন্তত তোমার ভুলের দায়িত্বটুকু নিয়ে নাও এবং বারবার নিজেকে বলো, এভাবে ঘটনাগুলো না ঘটলে অবশ্যই ভালো হতো। তবে এই লজ্জা, বিষণ্নতা, একাকিত্বের ভার বহন করার মতো মানসিক শক্তি তোমার রয়েছে। তোমার জীবনের কয়েকটি বছর ভালো কাটেনি তা ঠিক, তবে সেটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এত ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্ক দিয়েছেন যে সে তার উদ্যম আর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে জীবনের যেকোনো পর্যায়ে যদি নিজের সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাহলে অবশ্যই অনেক কিছু অর্জন করতে পারে। তুমি নতুন করে জীবন শুরু করবে এই ভাবনাটা অত্যন্ত ইতিবাচক, তবে পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে নয়। আমরা অনেক সময় খুব বেশি রাগ আর অভিমান বুকে নিয়ে আপন মানুষের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাই ঠিকই, তবে তা কিন্তু পরবর্তী জীবনের কোনো একসময়ে আবার আমাদের মনে বিষণ্নতা তৈরি করতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হলে আমাদের জীবনে এই পারিবারিক বন্ধনগুলো খুব জরুরি। আশা করব, তুমি যেখানেই যাও না কেন পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই তুমি তোমার লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী হবে। অনেক শুভ কামনা রইল।
সমস্যা: আমার বয়স ২০ বছর। আমি ২০০৬ সালে এইচএসসি পাস করেছি। আমার সমস্যা হলো কিছু ভালো লাগে না। আমি চার-পাঁচ বছর ধরে এ সমস্যায় ভুগছি। আমার কোনো বন্ধু নেই। নিজেকে অনেক একা মনে হয়। মনে হয় মরে যেতে পারলে ভালো হতো। আমি প্রায় তিন বছর ধরে একজন চিকিৎসকের ওষুধ সেবন করছি। কিন্তু এতে আমার কোনো উন্নতি হয়নি। এ কারণে আমার লেখাপড়া অনেক দিন বন্ধ ছিল। সম্প্রতি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু মন দিয়ে পড়তে পারছি না। কারণ, কোনো কিছু ভালো লাগে না। এখন আমি কী করব?
রনি
ঠিকানা পাওয়া যায়নি
পরামর্শ: তোমার চিঠিটা খুব ছোট বলে অনেক তথ্য নেই। তবে ২০ বছর বয়সে লেখা চিঠি থেকে যা বুঝতে পারলাম সেটা হচ্ছে, বয়ঃসন্ধিতে তোমার বিষণ্নতা শুরু হয়েছে। আর সে কারণেই তুমি কিছুদিন ঠিকমতো লেখাপড়া করতে পারোনি। এইচএসসি পরীক্ষার আগেই যদি সমস্যা শুরু হয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে তো অনেক বাহবা দেওয়া যায় এই মানসিক অবস্থায়ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছ বলে। তুমি তিন বছর ধরে কোন চিকিৎসক দেখিয়েছ এবং তিনি কোনো ধরনের ডায়াগনোসিস করেছেন কি না সেটি উল্লেখ করোনি। যেহেতু তুমি এতে উপকৃত হওনি, আমি অনুরোধ করব তুমি একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে প্রথমে সাহায্য নাও। তাঁরা অনেকখানি সময় দিয়ে তোমার আবেগ ও চিন্তাধারা বোঝার চেষ্টা করবেন এবং যদি কোনো মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে ওষুধ খাবার প্রয়োজন হয়, তাহলে তোমাকে তাঁরা কারও কাছে রেফার করে দেবেন। তোমার বয়স এখন খুব কম এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছ, কাজেই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে হলে মানসিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমি আগের বেশ কয়েকটি সংখ্যায় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের কোথায় যোগাযোগ করতে হবে ওই ফোন নম্বরগুলো দিয়েছি। তুমি সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই নেতিবাচক অনুভূতিগুলো থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পারবে। তাই পরিবারের লোকজনকে বলবে, তোমার এখন আর বিলম্ব না করে এই মুহূর্তে শুধু ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে থাকা চলবে না, একজন প্র্যাকটিসিং মনোবিজ্ঞানী বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং সাহায্য নেওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ওষুধ সেবন করার প্রয়োজন থাকলেও কাউন্সেলিং সেবাটি পাশাপাশি নিলে আমাদের মানসিকভাবে ভালো থাকাটা নিশ্চিত হয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৪, ২০১০
Leave a Reply