ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি কারও সঙ্গে মিশতে পারি না। কখন কার সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত, তা-ও বুঝি না। এ জন্য আমি স্বভাবতই কম কথা বলি। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ উল্টাপাল্টা কথা বলে বসি, যা হয়তো কেউ পছন্দ করছে না। আমি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী। যদিও বড় হয়ে লেখাপড়ায় আগ্রহ অনেক কমে গেছে বলে আমার ধারণা। আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। কিন্তু আমার মধ্যে এখনো কোনো পরিপক্বতা আসেনি। ছোট ছোট বিষয়ে আমি রাগ করে বসি, হঠাৎ খুব বেশি রাগ উঠে যায়। কিন্তু একাকী কিছুক্ষণ বসলেই আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে যাই। তখন নিজের আচরণের জন্য ভীষণ আফসোস হয়। কেন এমন করলাম, ভাবতে থাকি। তখন শুধু নিজেকে আঘাত করতে ইচ্ছা করে। আমার কোনো বান্ধবী নেই। মায়ের সঙ্গেই সবকিছু শেয়ার করি। কিন্তু মাঝেমধ্যে মা-ও বিরক্ত হয়ে যান। তখন নিজেকে খুব একা মনে হয়। মনে হয়, আমি একটা অন্ধকার কূপে পড়ে আছি। প্রচণ্ড কষ্ট হয়। আমার দুটি ভাই, কোনো বোন নেই। আমি শুধু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমার বাবা, ভাইয়েরা এ জন্য আমাকে খুব গালিগালাজ করেন, বকা দেন। তখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। দুয়েক দিন খুব কান্না করি। তারপর বাধ্য হয়ে আবার কথা বলি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
তেজগাঁও, ঢাকা।
পরামর্শ: নিজের সমস্যার ব্যাপারে সচেতন হয়ে আমাকে লেখার জন্য ধন্যবাদ। ছোটবেলা থেকে কিছুটা বিষণ্নতায় ভুগলে বয়ঃসন্ধিতে এসে এটি বেড়ে যায় বলে তোমার এখন এত অসহায় লাগছে। আর বিষণ্ন থাকলে আমাদের পক্ষে রাগ নিয়ন্ত্রণ করাও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তোমার মধ্যে এই কারণে আবেগীয় পরিপক্বতার কিছুটা অভাব লক্ষণীয়। কিন্তু কি জানো, তোমার যদি সত্যিই পরিপক্বতার অভাব থাকে, তবে এর জন্য কিন্তু তোমার কোনোভাবেই পুরোপুরি দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আশপাশের পরিবেশের প্রভাব এবং বংশগতভাবে আসা বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাবের কারণেই তোমার বর্তমান ব্যক্তিত্বটি গড়ে উঠেছে। তবে এই অসহায় অবস্থাটি এত বেশি পীড়াদায়ক হতো না, যদি তোমার মা-বাবা সচেতন হতেন। এবং ভাইয়েরা গালিগালাজ না করে তোমার অবস্থাটি বোঝার চেষ্টা করতেন। তোমাকে এই সময় মানসিকভাবে সমর্থন দেওয়া খুব প্রয়োজন। পড়াশোনায় যে তুমি ভালো করেছ, এর দ্বারা বোঝা যায় যে বুদ্ধির দিক থেকে তুমি মোটেও পিছিয়ে নেই। তবে আবেগ নিয়ন্ত্রণে তোমার যে অনেক দিন ধরেই অসুবিধা হচ্ছে, সেটি তোমার অভিভাবকদের অনেক আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। আমাদের সমাজের বেশির ভাগ অভিভাবক মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে একেবারে সচেতন নয় বলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের এ ধরনের সমস্যাগুলোকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেন। সন্তানের মধ্যে আচরণের সমস্যা দেখলে বরং তাদেরই এর জন্য প্রতিনিয়ত দোষারোপ করেন বলে সমস্যাগুলো আরও বেড়ে যায়। তোমার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে, এই মানসিক অবস্থার জন্য অপরাধবোধে ভুগে নিজের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়ো না। কোনোভাবেই নিজেকে আঘাত করার কথা একবারও ভাববে না। এই বয়সে বন্ধুবান্ধবহীন জীবন কাটাতে তোমার নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছে। কাজেই বিষণ্নতা তোমাকে আরও বেশি পর্যুদস্ত করে ফেলার আগেই সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে হবে। তুমি যেহেতু ঢাকাতেই থাকো, আমি আশা করব, তুমি অন্তত তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ মাকে বুঝিয়ে বলো যে তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন। তুমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সাইকিয়াট্রি বিভাগে সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে গিয়ে সাইকোথেরাপির জন্য নিজের নাম তালিকাভুক্ত করতে পারো। এ ছাড়া ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল (ফোন: ৮৩১৪৮৮৭), ক্রিয়া (ফোন: ৮১১৫৮৮৭) বা গুলশানের দর্পণে (ফোন: ৮৮৫৪৯৩৯) গেলেও তুমি সাইকোথেরাপির সাহায্য পাবে। বেশ কয়েকটি সেশন নিলে অবশ্যই উপকৃত হবে। শুভ কামনা রইল।
সমস্যা: আমি ঢাকার একটি সরকারি কলেজে মাস্টার্সে পড়ি। ছুটিতে বাড়িতে আসার পর আমার মুঠোফোনে একটি কল আসে, অচেনা একজন। তিনি বললেন, অন্য একজনের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর পেয়েছেন। যার পরিচয় দিলেন, আমি তাকে চিনি না। পরে কথা হয়। প্রায়ই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তিনি একটি কোম্পানির এমডি। তিনি একসময় আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। আমিও তাঁর সঙ্গে মিশতে থাকি। এখন আর তিনি আগের মতো ফোন করেন না এবং জিজ্ঞেস করলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখান। আমি একদিন হঠাৎ রেগে যাই এবং এরপর রাগ করে ফোন রেখে দিই। তার পর থেকে তিনি আর ফোন করছেন না। এখন আমার সমস্যা হলো, আমি তাঁকে আবেগের মোহে ভালোবেসে ফেলেছি। তাঁর ব্যবহারে এতটাই কষ্ট পেয়েছি যে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এখন কী করব।
অনামিকা
ঢাকা।
পরামর্শ: তোমার সঙ্গে ভদ্রলোকের পরিচয় পর্বটিতেই বেশ অস্পষ্টতা এবং লুকোচুরি ছিল। তিনি যার কাছ থেকে তোমার ফোন নম্বর নিয়েছেন, তাকেও তুমি চিনতে পারলে না, অথচ ভদ্রলোককে এতটা বিশ্বাস করে তাঁর সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুললে। এটি কিন্তু খুব বোকামি হয়েছে। তুমি কি তাঁর পরিবার বা আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে কোনো ধারণা পেয়েছিলে বা তাঁর বাড়িতে কখনো গিয়েছ? তা যদি না হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তাঁর দিক থেকে স্বচ্ছতা ও সততার যথেষ্ট অভাব ছিল। এভাবে তথ্য গোপন করে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেগুলোর ভিত্তি খুব নড়বড়ে হয় এবং তা স্থায়িত্ব লাভ করে না। তোমাকে তাঁর আচরণের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে ভদ্রলোক যে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিলেন, এতে করে কি এটাই বোঝায় না যে তিনি এই সম্পর্কটির ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না? তোমার দিক থেকে যা ঘটেছে তা হচ্ছে, তুমি তাঁর প্রতি আবেগীয়ভাবে অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলে। তাঁর সঙ্গ এবং আলাপচারিতার প্রতি তোমার মধ্যে তীব্র আসক্তি তৈরি হয়েছে। অথচ এই ভদ্রলোক তোমার মতো সরল মেয়ের ব্যক্তিগত সীমারেখায় অনুপ্রবেশ করে তোমাকে পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত করে যখন তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ ধরনের অনেক মানুষ আমাদের সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তাঁর মুখোশটি যে তোমাদের কোনো স্থায়ী সম্পর্ক হওয়ার আগেই উন্মোচিত হয়েছে, এটি কিন্তু একদিক থেকে তোমার জন্য একটি আশীর্বাদও বটে। তবে তুমি অবশ্যই এই সম্পর্কটি তৈরির ক্ষেত্রে তোমারও যে পঞ্চাশ ভাগ বা অর্ধেক অবদান ছিল, সেই দায়িত্বটুকু গ্রহণ করবে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ইচ্ছা ছিল বলেই এই সম্পর্কটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, তাই না? আশা করি, এই অভিজ্ঞতা তোমার মনের বয়সটিকে অনেক বাড়িয়ে দেবে। ভবিষ্যতে শুধু আবেগের বশে সাময়িক সুখের জন্য একেবারে হঠাৎ করে আবির্ভূত হওয়া একটি মানুষের সঙ্গে তুমি নিশ্চয়ই এতটা ঘনিষ্ঠ হবে না। এর পর থেকে তুমি আরও যুক্তিনির্ভর হবে এবং সতর্ক হয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলবে। সময়ের সঙ্গে তুমি এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যা যা তোমার ভালো লাগে, এমন কিছু সুস্থ বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে। এ ছাড়া কিছু সৃজনশীল এবং ফলপ্রসূ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। ভালো থেকো।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩০, ২০১০
Leave a Reply