ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার দুই ভাই ও এক বোন। প্রায় আট বছর হলো আমার বোনের বিয়ে হয় আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে। আমার দুলাভাই মোটামুটি শিক্ষিত ছিলেন। আমার একটি ছোট ভাগনি আছে, যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।
আমার বোন একটি ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা সদস্য ছিল এবং সেই সুবাদে ব্যাংকের টাকা সংগ্রহকারী একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আমার দুলাভাইয়ের অনুপস্থিতিতে এই পরিচয় থেকে তাদের সম্পর্ক প্রণয়ে গড়ায় এবং গত বছর আমার বোন ওই লোকের সঙ্গে পালিয়ে যায়। এখন আমার বোন মুঠোফোনে আমাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বলে, সে ভালোই আছে। কিন্তু ঠিকানা আমাদের দেয় না।
এ ঘটনার পর আমার বাবা বাকশক্তিহীন। সমাজের মানুষ আমাদের খারাপ চোখে দেখে। সবচেয়ে দুঃখ লাগে আমার ছোট্ট ভাগনির দিকে তাকালে। শুনেছি তার বাবা বিয়ে করবে। এমতাবস্থায় আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আমাদের পরিবার মোটামুটি সচ্ছল। আমি বাবার দিকে তাকাতে পারি না। লজ্জায়, অপমানে তিনি নির্বাক হয়ে গেছেন। মনে হয় তাঁকে (আপা) খুঁজে এনে খুন করে ফেলি। আমার মা নেই।
আলমগীর কবীর শাহ
দিনাজপুর
পরামর্শ: পরিবারের প্রতি তোমার দায়িত্বশীল এবং মমতাময় মনোভাব খুবই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে বাবার প্রতি তোমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার অনুভূতিও খুব ইতিবাচক একটি উদাহরণ। তবে বোনের প্রতি এতটা রাগ বা ঘৃণা কিন্তু তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বোনটিকে বাবা কত বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন, তা বুঝতে পারছি না। ওকে কি যথেষ্ট লেখাপড়া করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল? তোমরা যেহেতু আর্থিকভাবে সচ্ছল, বোনটির সেই সুযোগ থাকার প্রয়োজন ছিল। আমাদের দেশের মেয়েদের প্রায়ই এত অল্প বয়সে বিয়ে হয় যে তারা তাদের কৈশোরটি প্রায় হারিয়ে ফেলে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সব দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে এবং সন্তানের জন্মের পর আরও বেশি করে বন্দী হয়ে মেয়েরা নিজেদের সুস্থ বিনোদনের চর্চাগুলোও করতে পারে না। অবশ্যই তার অর্থ এই নয় যে, এই কারণে তাদের নৈতিক স্খলন ঘটবে এবং সমাজ তা মেনে নেবে। আমার মতামত হচ্ছে, আর্থিক অনটন না থাকলে প্রতিটি মা-বাবার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের ছেলে-সন্তানটির মতো মেয়ে-সন্তানটিকে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়ে তারপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়ে দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, পরিবারে সামাজিক-নৈতিক মূলবোধের চর্চার সঙ্গে জীবন-দক্ষতা অর্জনের জন্য সহায়ক চর্চাগুলোও অভিভাবকদের খুব সচেতনভাবে করতে হবে, যাতে তাঁরা সন্তানদের জন্য রোল মডেল হতে পারেন। এর পরও যদি সন্তানেরা বিপথগামী হয়, তাহলে সেটি ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। সন্তানেরা বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনের অঙ্গীকার রক্ষা করতে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে বুঝতে হবে, অভিভাবকেরাও না জেনে কিছু ভুল করে ফেলেছেন, যে কারণে বিপর্যয় ঘটে গেছে। কাজেই সন্তানদের এসব আচরণে অভিভাবকেরা ভেঙে না পড়ে বা সম্পূর্ণ দোষ সন্তানের কাঁধে না চাপিয়ে যদি নিজেদের ভুলের কিছু দায়িত্বও মাথায় নিয়ে নেন, তাহলে ভালো হয়। সেই সঙ্গে আবেগতাড়িত না হয়ে মনের যুক্তির জায়গাটি ব্যবহার করে যদি নিজেকে শান্ত রাখেন, তাহলে এতটা কষ্ট হয় না। আমরা বর্তমানে পারিবারিক মূল্যবোধগুলোর ঠিকমতো চর্চা করছি না এবং সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে যোগাযোগ বেড়ে গেছে বলে এ ধরনের অঘটনগুলো খুব ঘটছে। অনেক বিবাহিত মানুষই ভুলে যাচ্ছে যে, তাদের বিয়ের প্রতি এবং সন্তানের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং সশ্রদ্ধ থাকতে হবে। তোমার বাবাকে বলো, বোনটি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। সে যা করেছে, এর পেছনে অনেক কারণই থাকতে পারে। তার কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বর্তমানে সে-ই বহন করছে। এ জন্য তোমাদের সবার ছোট হয়ে বা মাথা নিচু করে চলার প্রয়োজন নেই। কারণ তাতে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না। পরিবারকে বাঁচানোর জন্য তোমার একার প্রচেষ্টায় কিছু হবে না, তোমাদের সবাইকে আলাদা করে নিজেদের মনের এবং শরীরের যত্ন নিতে হবে। যত বড় ধাক্কাই আসুক না কেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা সবাই একেকটি পৃথক সত্তা এবং প্রত্যেকের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে নিজের ভুলগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে অন্যদের দোষারোপ না করে ভালোভাবে বেঁচে থাকা। তোমার প্রতি অনুরোধ রইল, তুমি বোনকে খুন করার চিন্তা কখনো মাথায় না এনে বরং ওকে একজন মানুষ হিসেবে দেখো এবং মনে করো কেবল মানুষই জীবনের বাস্তবতায় পড়ে ছোট-বড় অনেক ভুল করে ফেলে। বোনের ছোট্ট মেয়েটিকে তোমাদের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করবে না—এই আশা রাখছি। শুভ কামনা রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৩, ২০১০
Leave a Reply