ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: এসএসসি পরীক্ষায় আমি এ+ পেয়েছি। ফলাফলের আগে মা-বাবা আমাকে সবসময় বলতেন, আমাকে ভালো কলেজে ভর্তি করে দেবেন। কিন্তু পরে তা না করে আমাকে একটি গ্রামের কলেজে ভর্তি করে দেন, যেখান থেকে পড়াশোনা করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছি, আমাকে যদি একটি ভালো কলেজে ভর্তি করে না দেওয়া হয়, তবে আমি পড়াশোনা ছেড়ে দেব, অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
দিনাজপুর।
পরামর্শ: বুঝতে পারছি, মা-বাবা তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেছেন বলে তুমি খুব হতাশ হয়েছ এবং দুঃখ পেয়েছ। সন্তানকে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত নয়, যেটি অভিভাবকেরা রক্ষা করতে পারবেন না, বা আন্তরিকভাবে চাইছেন না। তবে অনেক সময় বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে তাঁরা অসহায় হয়ে পড়েন এবং অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তোমার কি মনে হয়, তাঁরা ইচ্ছা করেই তোমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন? যদি তা-ই হয়, তবে তাঁরা খুব বড় ধরনের ভুল করেছেন, বলতে হবে। কারণ, এতে করে সত্যিই সন্তানদের মন ভেঙে যায়। আর যে কারণেই তাঁরা এটি করেন না কেন, তাঁদের কিন্তু অবশ্যই সন্তানের কাছে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যাটি খুব ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে। গ্রামের কলেজে পড়তে তোমার একেবারে ভালো লাগছে না তা সত্যি। তবে তোমার মতো একজন উজ্জ্বল শিক্ষার্থী যদি এই সময়টিতে সারাক্ষণ মন খারাপ করে কাটায়, তাহলে তো এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করা সম্ভব হবে না, তাই না? তুমি রাগ না করে মা-বাবার কাছ থেকে জানার চেষ্টা করো, তাঁরা কী কারণে এমনটি করেছেন এবং এখন কিছু করা সম্ভব কি না। হয়তো বা তাঁদের কাছে এই আচরণের একটি গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে পারে। যদি এখন কলেজ পরিবর্তন করা একেবারেই অসম্ভব হয়, তাহলে প্লিজ আর সময় নষ্ট না করে শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নাও। এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করতে পারলে তুমি তোমার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য পূরণের দিকে সুন্দরভাবে এগোতে পারবে। আমি আশা করব, তুমি আত্মহত্যার কথা আর কখনো ভাববে না। যেখানেই পড়ো না কেন, নিজের গুরুত্ব এবং সম্মান একটুও কমে গেছে বলে ভাববে না। এ ছাড়া নিজেকে তোমার অনেক বেশি ভালোবাসতে হবে। তোমার মধ্যে যেসব ভালো গুণ আছে, সেগুলোর আরও বিকাশ ঘটাবে এবং যে জায়গাগুলোতে দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলো চর্চার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূণর্, তুমি একজন মানুষ হিসেবে নিজের ভেতরটি কতটা সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলেছ। কারণ, তুমি মনের দিক থেকে যত বেশি সুন্দর হবে, ততই সব পর্যায়ের মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে এবং সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা করবে। তুমি কোন কলেজে পড়েছ, সেটি কিন্তু তখন একেবারেই গৌন হয়ে যাবে।
সমস্যা: স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমি একটি ছেলেকে ভালোবাসি। আমাদের সম্পর্ক প্রায় চার-পাঁচ বছরের। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন হঠাৎ আমাকে জোর করে বিয়ে দেন। কিন্তু এই বিয়ে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের সুখের জন্য চেষ্টা করেছি মানিয়ে নেওয়ার, কিন্তু পারছি না। শুধু আমার প্রেমিকের কথা মনে পড়ে। আমার স্বামীকে আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার স্বামী কাছে এলে আমার ভালো লাগে না। নিজের কাছে অসহ্য লাগে।
ইচ্ছে হয় মরে যেতে। ছেলেটির সঙ্গে আমার এখনো সম্পর্ক আছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এইচএসসি পরীক্ষার পর ওকেই বিয়ে করব। এই সিদ্ধান্তটা কি আমার ঠিক হয়েছে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
কুড়িগ্রাম।
পরামর্শ : তোমার কত দিন ধরে বিয়ে হয়েছে এবং বিয়ের সময় বয়স কত ছিল, তা উল্লেখ করোনি। তুমি লিখেছ, এইচএসসি পরীক্ষার পর মিজানকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে। তার মানে কি এই দাঁড়ায়, তোমার অপ্রাপ্ত বয়সে প্রথম বিয়েটি হয়েছে? তুমি স্কুল পর্যায়ে একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলে বলেই কি অভিভাবকেরা তোমাকে এত অল্প বয়সে তাড়াহুড়ো করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেন? তা-ই যদি হয়, তাহলে এটি তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। বয়ঃসন্ধিকালে অনেকেই ভুল করে খুব গভীর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ফলে অভিভাবকেরা দিশেহারা হয়ে মেয়েটির অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু তাঁরা যদি সন্তানের সঙ্গে সুন্দরভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতেন এবং মেয়েটির লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যে কত জরুরি, সেটি খুব যুক্তির সঙ্গে তুলে ধরতেন, তাহলে তোমার মতো অনেক মেয়েই এ ধরনের পরিস্থিতির হাত থেকে বেঁচে যেত। তবে একটি সুষ্ঠু আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয় তখনই, যখন অভিভাবকদের সঙ্গে তাঁদের সন্তানদের একটি পরম আস্থার এবং বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকে। তুমি লিখেছ, স্বামীকে মেনে নিতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে এবং তুমি ওই ছেলেটির সঙ্গে এখনো সম্পর্ক রাখছ। তোমাকে কিন্তু এখন যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত খুব ভালো করে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। কারণ, বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা তোমার জীবনে ঘটে গেছে। যদি মনে হয় তুমি তোমার অভিভাবকদের সত্যিই খুব ভালোবাসো, তাহলে প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে বিয়ের সম্পর্কটির ওপর প্রচুর মনোযোগ দিতে হবে। স্বার্থ ত্যাগ করে এটিকে একটি সুস্থ সুন্দর রূপ দিতে হবে। বিয়ে যেহেতু সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি একটি সম্পর্ক, এটিকে অনেক বেশি মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজন থাকে। এই সম্পর্কের প্রতি যদি আমরা আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ না থাকি, তাহলে জীবনে বিপর্যয় ঘটে যায়। আমাদের নিরীহ সন্তানেরাও তখন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বিষণ্নতায় ভোগে, নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে বিপথগামী হয়ে যায়। আর যদি তোমার মনে হয়, তুমি কোনোভাবেই এই বিয়ে মানতে পারবেনা , তাহলে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে তোমাকে বর্তমান বিয়ের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এরপর যা যা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেগুলোও মাথায় রেখে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। এ ছাড়া তোমাকে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হবে, যেন পরে কোনো অসুবিধা হলে তুমি আর কাউকে দায়ী না করে এটিকে সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত হিসেবে সব সময় শ্রদ্ধা করতে পারো। তুমি হয়তো আমার কাছ থেকে একটি পথনির্দেশনা প্রত্যাশা করে চিঠি লিখেছ, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা যাঁরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছি, তাঁরা কেউই এসব ব্যাপারে সরাসরি সিদ্ধান্ত দিই না। কারণ, এটি আমাদের নীতির বাইরে। সিদ্ধান্ত বা সরাসরি সমাধান না দেওয়ার পেছনে দুটি বড় কারণ হচ্ছে, এতে করে ক্লায়েন্টরা কাউন্সেলরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং তাদের যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, সেটি তারা বুঝতে পারে না। আর নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিলে সেটির দায়িত্ব গ্রহণ করার বিষয়টিও কাজ করে না। আশা করি, তুমি তোমার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবে। যাকেই গ্রহণ করো, তার সঙ্গে একটি সুস্থ দাম্পত্য জীবনের জন্য যা যা করণীয়, তা করবে। শুভ কামনা রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৬, ২০১০
Leave a Reply