ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: সামনে ভর্তি পরীক্ষা, অথচ আমি খুব ভালোভাবে পড়শোনা করতে পারছি না। মাথায় সারাক্ষণ একটা চাপ অনুভব করি। কিসের চাপ, নিজেও বুঝি না। কখনো মনে হয়, এত বেশি পড়া শেষ করতে পারব কি না। আবার কখনো মনে হয়, ভালো কোথাও ভর্তি হতে না পারলে বাসা থেকে বকা শুনতে হবে। এইচএসসির ফল বের হওয়ার পর থেকেই আমি খুব হতাশার মধ্যে আছি। কীভাবে আমি এই হতাশা থেকে বের হব? কিছুই ভালো লাগে না। নিজেকে গোছাতে পারছি না। মানসিকভাবে নিজেকে খুব বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে। এসব কি কোনো রোগ?
অর্পিতা
সিলেট।
পরামর্শ: উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তোমার ফল মনে হচ্ছে আশানুরূপ হয়নি। আর তুমি নিশ্চয়ই অনেক হতাশা ও অপরাধবোধে ভুগছ। এ ছাড়া বাড়ির লোকজনের কাছ থেকেও হয়তো বা বেশ বকাঝকা শুনতে হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের ফল বের হওয়ার আগে থেকেই তোমরা ভর্তি পরীক্ষার চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাক বলে অনেক বেশি মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। আর সে কারণেই তোমার ভেতর হতাশা, দুশ্চিন্তা, ভয়, অপরাধবোধ, অনিশ্চয়তা—সবকিছু একসঙ্গে হয়ে তোমার চাপটি বেশি হয়েছে। এ ধরনের ক্রান্তিকালে আমরা যদি মনকে বর্তমান সময়ের মধ্যে আটকে রাখতে পারি, তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। নিজেকে আমরা খুব জোর দিয়ে এবং যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি, অতীতকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, অতীতের হতাশাগুলো নিয়ে আমি আর ভাবব না, আর ভবিষ্যৎ যেহেতু আমাদের কারও জানা নেই, ভবিষ্যতে কী হবে—সেই ভাবনা মাথায় রাখব না। এভাবে বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে পারলে আমরা এই সময়টাকে সবটুকু প্রচেষ্টা ঢেলে দিয়ে কাজে লাগাতে সক্ষম হব। লেখাপড়া আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাতে সন্দেহ নেই; তবে লেখাপড়াই কিন্তু সবকিছু নয়। তুমি নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়ে চলছ ঠিকই, তবে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে পড়ার সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখলে পরবর্তী সময়ে তোমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব না হলেও কষ্ট কম হবে।
আসলে যে বিষয় নিয়েই পড়ো না কেন, বিষয়টি কিন্তু উপভোগ করতে হবে। এতে করে ভালো ফল করাও সম্ভব হয়। আমি আশা করব, তুমি বিকল্প বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেবে। আর সারাক্ষণ পড়াশোনা না করে তুমি যদি কিছু সুস্থ বিনোদনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করো, তাহলে ভালো হয়। এ ছাড়া শরীরচর্চা, ইয়োগা, রিলাক্সেশন এক্সারসাইজ নিয়মিত করতে পারলে খুব উপকার পাওয়া যায়। এতে তোমার শরীর ও মন দুটোই সতেজ থাকবে। সারা দিনের মধ্যে একটি নির্জন সময় বেছে নিয়ে তুমি নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবে এবং নিজেকে কোনো দোষারোপ না করে নিঃশর্তভাবে ভেতরের সত্তাটিকে গ্রহণ করে নিয়ে নিজের সঙ্গে ইতিবাচক কথোপকথন করবে। অর্থাৎ নিজেকে সাহস দেবে, উৎসাহ দেবে ও স্বীকৃতি দেবে।
সমস্যা: কলেজের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আমার এক সহপাঠীকে দেখে খুব ভালো লাগে। এর আগে কোনো দিন কোনো মেয়েকে দেখে আমার এত ভালো লাগেনি। আমি তাকে আমার জীবনের প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দিই। কিন্তু সে মেনে নেয়নি। এরপর সে আমাকে ভালো বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়। আমিও তাকে ভালো বন্ধু হিসেবে মেনে নিই। তার সঙ্গে ফোনে অনেক কথা বলি। কথা বলতে বলতে তার প্রতি আমার বিশ্বাস সৃষ্টি হয় এবং তাকে আমি আমার নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। এভাবে একটি বছর চলে যায়। পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পারি, দুু-তিনটি ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এখন তার সঙ্গে আমার কথা বলতে খারাপ লাগে এই ভেবে যে সে অনেককেই কষ্ট দিয়েছে। তাকে যখন আমি কলেজে দেখি, তখন আমার অত্যন্ত কষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি সবকিছু কেন জানলাম? তার প্রতি আমি আমার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। এসব কারণে আমার পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
পরামর্শ: তোমাদের সম্পর্কের শুরুতে একটি ভুল হয়েছে। মেয়েটি তোমাকে বন্ধুর স্থান দিয়েছে, অথচ তুমি কিন্তু তার প্রতি অনুরক্ত ছিলে। যখন এ ধরনের সম্পর্ক চলতে থাকে, তখন যে মানুষটির মধ্যে প্রেমের অনুভূতি থাকে, তার ভেতরে একটু একটু করে প্রত্যাশা জমা হতে থাকে। সে ভাবতে থাকে, হয়তো বা অন্যজন তাকে বন্ধু হিসেবে নয়, প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেই গ্রহণ করে নিচ্ছে। যত বেশি কথা হয় বা দেখা হয়, প্রত্যাশার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে। অনেক সময় যে মানুষটি ‘শুধু বন্ধু’র ভূমিকায় থাকে, সে কখনো সচেতন ও কখনো অবচেতন মনের প্রভাবে এমন কিছু ইঙ্গিত দিতে থাকে যে অন্য পক্ষ আরও বেশি আশার আলো দেখতে শুরু করে। এই আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকার ফলে একটি জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত দুজনই নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ে সম্পর্কটির ইতি ঘটায়। তুমি ভেবে দেখ, তোমার ক্ষেত্রেও ঠিক সে রকমটি ঘটেছে কি না। মেয়েটিকে তুমি নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেছিলে—এ ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি।
আমাদের কিন্তু সবার আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখতে হবে, তা না হলে খুব অসুবিধায় পড়তে হয়। তুমি নিজেকে এই প্রশ্নটিও করে দেখতে পারো যে, মেয়েটিকে তুমি শুধু একজন বন্ধু হিসেবে দেখতে পেরেছিলে কি না। যদি সে একজন ভালো বন্ধু হয়েই থাকে, তাহলে মেয়েটির
অনৈতিক কোনো কার্যকলাপ তোমার পছন্দ না হলে সেটি তাকে বলার অধিকারটুকু তুমি চর্চা করতে পারতে।
এখনো সম্ভব হলে তাকে কলেজে দেখে মন খারাপ করে
বসে না থেকে সরাসরি তার কাছ থেকে বিষয়টি যাচাই
করে নিতে পারো।
মেয়েটি স্বীকার বা অস্বীকার যা-ই করুক না কেন, তুমি যা বিশ্বাস করবে, সে অনুযায়ী তাকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে তোমার চিন্তাধারাগুলো জানাতে পারো। মেয়েটির মধ্যে যদি নৈতিক মূল্যবোধের অভাব থাকে, তুমি তো সেটি পরিবর্তন করতে পারবে না। আমার অনুরোধ হচ্ছে, নিজের প্রতি মর্যাদা বা সম্মান এবং প্রচুর বিশ্বাস নিয়ে জীবনটাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে পথ চলো। ভবিষ্যতে এর চেয়েও আরও বড় ধাক্কা আসতে পারে, কাজেই তোমাকে অনেক বেশি মানসিক শক্তি ধরে রাখতে হবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৯, ২০১০
Leave a Reply