ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। ঢাকা থেকে অনেক দূরে গ্রামের এক নিরক্ষর পরিবারে আমার জন্ম। আর্থিক দিকও ভালো নয়। আমি উপশহরের এক ছাত্রাবাসে থাকি এবং টিউশনি করে খরচ জোগাড় করি কিছু অংশ। নিরক্ষর পরিবারে আমি সামান্য শিক্ষিত বলে দায়িত্বটাও মনে হয় একটু বেশি। কিন্তু আমি খুব সামান্য ব্যাপারেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমি বড় মাপের কয়েকজন লেখকের বইও পড়েছি। কেউ বলেছেন, পৃথিবীতে চেষ্টা করলে সবকিছুই করা সম্ভব। আবার কেউ বলেছেন, ক্ষমতার বাইরে কিছু করতে যেয়ো না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। আমি মনে হয় অন্যের দ্বারা একটু বেশিই প্রভাবিত হই। আমি চাই, যেটা বিশ্বাস করব সেটাই যাপন করব; কিন্তু কোনোটির ওপর জোরালো বিশ্বাস হয় না। আমার প্রবল ইচ্ছে—আপনার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হওয়া আর মানুষকে সেবা করে যাওয়া। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তোমার জীবন-দর্শন এবং নিজের বিকাশ ঘটানোর প্রয়াসকে অভিনন্দন। আমি নিশ্চিত যে তোমাদের মতো পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল ছেলেমেয়েরা অন্যদেরও প্রেরণা জোগাবে। তুমি নিজের সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার বিষয়টি চিহ্নিত করতে পেরেছ। বোঝা যাচ্ছে, তোমার মনটিও শিক্ষিত। এই উপলব্ধিটি তোমাকে এই অসুবিধা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করবে। তুমি ভালো লেখকদের বই পড়ে জেনেছ যে ‘চেষ্টা করলে সবকিছুই করা যায়’ এবং ‘ক্ষমতার বাইরে কোনো কিছু করা ঠিক নয়’—এ দুটি কথাই কিন্তু সত্যি। আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কাজগুলো ভিন্ন, আবার প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সেগুলো ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করে। আর সে কারণেই আমরা প্রত্যেকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার সংমিশ্রণ দেখতে পাই এবং কেউ আমরা কারও মতো নই। মস্তিষ্কের বিভিন্ন ক্ষমতা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে এবং অনেক নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। আমরা নিজেরাও জানি না আমাদের পক্ষে কোন কোন ক্ষেত্রে কী অর্জন করা সম্ভব। আর সে কারণেই বিখ্যাত লেখকেরা বলেছেন চেষ্টার কোনো ত্রুটি না করতে। সময়ই বলে দেবে আমরা কে কতটুকু অর্জন করার ক্ষমতার অধিকারী। আবার এটাও ঠিক যে কোনো একটি কাজে দীর্ঘক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পরও যদি সেভাবে সাফল্য না আসে, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা সেই বিশেষ কাজটির পেছনে আর সময় দেব কি না। যেমন—কারও হয়তো অঙ্কে দক্ষতা ভালো নয়, কিন্তু সে সাহিত্য বা কাব্য রচনার ক্ষেত্রে অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। কাজেই আমাদের নিজেদের বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তা ছাড়া এ ধরনের বক্তব্যগুলোকে খুব জোরালো বিশ্বাসের সঙ্গে মনে স্থান না দিয়ে বরং কিছুটা মধ্যপন্থী হওয়াটা ভালো। অর্থাৎ সাদা-কালো নয়, আমরা ধূসর রংটি বেছে নিতে পারলে ভালো হয়। এতে করে জ্ঞান অন্বেষণের জায়গাটি উজ্জীবিত থাকে। তুমি যদি নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস ধরে রাখো এবং তোমার পক্ষে কোনো কাজে নির্দিষ্ট সময়ে যতটুকু প্রচেষ্টা দেওয়া সম্ভব, সেটুকু আন্তরিকভাবে দাও, তাহলে ভালো হয়। কোনো কাজে সফল হলে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে উৎসাহিত করবে। অসফল হলে হতাশায় না ডুবে, নিজের নেতিবাচক সমালোচনা না করে তোমার যে জায়গাটির উন্নয়ন ঘটানো দরকার, সেটির প্রতি মনোযোগী হবে। আমার মতো বা অন্য কারও মতো হওয়ার জন্য নয়, তুমি তোমার মতো করে নিজের বিকাশ ঘটাতে থাকো। মানুষের সেবা করতে হলে নিজের মন আর শরীরের যত্ন নিতে হয়—সেটি সব সময় মনে রাখবে, কেমন?
সমস্যা: আমার বয়স ২৮ বছর। বিয়ে হয়েছে তিন বছর হলো। পারিবারিক কারণে এখনো মা-বাবার বাসায়ই থাকি। তবে সমস্যাটা মিটে গেলে আলাদা বাসায় চলে যাব। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি মাঝেমধ্যে রাতে প্রচণ্ড ভয় পাই, ভয়ে ঘুমাতে পারি না। ছোটবেলা থেকেই আমি রাতে একা ঘরে ঘুমাতে পারি না। সব সময়ই কাজের মেয়ে অথবা কেউ না কেউ রুমে থাকে। বিয়ের পর আমার স্বামী অফিস বা পারিবারিক কারণে তাঁর বাসায় রাত কাটালে সেই দু-এক রাতেও আমার ভয়ে ঘুম হয় না। এ সময় রুমে কাজের মেয়ে থাকলেও বেশি ভয় পেলে মাকে ডেকে নিয়ে ঘুমাই। আমরা ১০ তলা অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। ইদানীং যে সমস্যাটা হচ্ছে, তা হলো ভূমিকম্পের ভয়। এর আগে দুবার রাতের বেলায় ভূমিকম্পের সময় ভবন ভীষণ কেঁপে উঠেছিল। ১০ তলা হওয়ায় কম্পনটা খুব বেশি মাত্রায় টের পেয়েছিলাম। এর পর থেকে বিছানায় শুতে গেলেই মনে হয়, এই বুঝি খাট দুলে উঠল! প্রচণ্ড ভয়ে শরীর অবশ হয়ে আসে। বুঝতে পারছি না কী করব। সারা রাত ঘুমাতে পারি না। আমি হরর মুভি দেখতে খুব পছন্দ করি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
ঢাকা।
পরামর্শ: আমাদের অবচেতন মনটি সত্যিই রহস্যজনক। সেখানে আমরা পীড়াদায়ক অনুভূতি উদ্রেককারী স্মৃতিগুলো মনের অজান্তেই সচেতন মন থেকে সরিয়ে ক্রমাগত অবদমিত করতে থাকি। তোমার অবচেতন মনে কোনো ঘটনা বা কারও কারও কাছ থেকে পাওয়া বার্তাগুলো ভিত্তিহীন বিশ্বাস হয়ে মনের গভীরে দৃঢ়ভাবে স্থান নিয়েছে। এটিকে মনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় ‘কন্ডিশনিং’ বলা হয়। তোমার এই অহেতুক ভয়ের কারণে আশপাশের মানুষগুলোরও কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। তারা তোমাকে খুব ভালোবাসে বলেই হয়তো ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত সহায়তা করে এসেছে। তবে এতে করে সত্যিকার অর্থে তোমার কোনো উপকার না হয়ে বরং অপকারই হয়েছে। যে আচরণগুলো সমাজে চলতে হলে আমাদের জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বরং কাছের মানুষেরা সাহায্য করলে ভালো হয়। তুমি এখন ১৮ বছরের একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ; কিন্তু ঘুমাতে যাওয়ার সময় তুমি একেবারেই ছোট্ট একটি শিশুর মতোই আচরণ করছ। বয়সের সঙ্গে তোমার আচরণটি তাই মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।
তোমার আবেগীয় সত্তার বয়সটি, বর্তমানে তোমার যে বয়স সেই বয়সের কাছাকাছি যাতে আসতে পারে, সে লক্ষ্যে তোমাকে সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে হবে। বেশ কিছুদিন নিয়মিত থেরাপি নিলে তুমি এই অসুবিধা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগে বা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ‘ক্রিয়া’তে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা বসেন, তুমি তাঁদের কারও কাছ থেকে সাহায্য নাও। আর ভূমিকম্পের ভয়ের ব্যাপারে বলব, আমরা সবাই প্রায় এটা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেই আছি এবং এটি বাস্তবসম্মত। যেহেতু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা কেউ জানি না, তাই এ নিয়ে অতিরিক্ত আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্প হলে কী কী করা সম্ভব, সেই অনুশীলনগুলো করতে পারি। তুমি ইন্টারনেটে বা পত্রপত্রিকায় সেই নির্দেশনাগুলো পাবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০২, ২০১০
Leave a Reply