ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: আমি আমার জেলা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বেশির ভাগ সময় কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ থাকে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জেলার একটি মেয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমার পরিচয় হয়। মুঠোফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগত। অল্প কিছুদিন পর আমি জানতে পারি, সে আমার তিন বছরের বড়। ব্যক্তিজীবনে আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। এ অবস্থায় আমি তার প্রেমের সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাই। তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে তার সঙ্গে আজও দেখা না করায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
এ ঘটনার পর আমি আবার ফোনে তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। তার দুটি ছবি চাই। তার পাঠানো ছবি আমার পছন্দ না হওয়ার কথা আমি আজও তাকে জানাতে পারিনি। আজকাল ফোনে তার সঙ্গে খুব কম কথা বলি। সে আমাকে কথায় কথায় আত্মহত্যার হুমকি দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: মুঠোফানে দীর্ঘ সময় মেয়েটির সঙ্গে কথা বলায় তোমার প্রতি ওর আবেগীয় নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। কাউকে ভালোভাবে না জেনে, তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুললে পরবর্তী সময়ে অনেক বেশি জটিলতা তৈরি হয়। মেয়েটির বয়স কত, তার পরিবারের ধরন কেমন—এসব কিছু না জেনেই তুমি তাকে ভালোবাসার আশ্বাস দিয়ে ভুল করে ফেলেছ। মুঠোফোনের অপব্যবহারের ফলে তোমাদের মতো তরুণদের জীবনে এ সমস্যাগুলো তৈরি হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, তুমি এখন মেয়েটিকে শুধু বন্ধু হিসেবে দেখতে চাইছ। কিন্তু মেয়েটি যেহেতু তোমাকে শুধু বন্ধু হিসেবে দেখতে রাজি নয়, এ সম্পর্কটি তোমাদের কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না এবং সব সময় এতে টানাপোড়েন থাকবে। মেয়েটি যে তোমাকে আত্মহত্যার ভয় দেখাচ্ছে, তার সবটুকু দায়িত্ব কিন্তু ওকেই নিতে হবে। এভাবে ভয় দেখিয়ে বা জোর করে কারও মন পাওয়া সম্ভব নয়, এটা মেয়েটিকে অবশ্যই বুঝতে হবে। আর যেহেতু সে কোনো কিছু পেতে হলে আত্মহত্যার কথা বলে, এই প্রবণতা তার মধ্যে পরবর্তী সময়ে থাকার আশঙ্কাও রয়েছে। তুমি এ কথা মোটেও ভাববে না যে তুমি ওর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে ওকে বাঁচিয়ে রাখছ। মেয়েটির জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে নিজের ভেতরেই শক্তি অর্জন করে নিজেকে ভালোবেসে এবং শ্রদ্ধা করে বেঁচে থাকতে হবে। তুমি ওকে ধৈর্য ধরে এবং খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলো। পারস্পরিক অনুভূতি দুই রকম থাকলে মেয়েটি তোমার কাছ থেকে শুধু কষ্টই পেতে থাকবে। তার চেয়ে বরং সে যদি বাস্তবতাকে মেনে নেয়, তাহলে তার জীবনটা স্বাভাবিক গতিতে চলবে। তোমার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে মেয়েটি যে তোমার নিঃসঙ্গ জীবনে আলো জ্বালিয়েছিল, সে জন্য তার প্রতি তুমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে—এ কথাটি তাকে বলো। ফোনে যোগাযোগ না করলেও তুমি দূর থেকে সব সময় ওর শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকবে, সেটাও তাকে আন্তরিকতার সঙ্গে জানাও।
সমস্যা: আমি ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছি। আত্মবিশ্বাসের অনেক ঘাটতি ছিল আমার মধ্যে। আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম, ওকে না পাওয়ার কষ্ট, সবকিছু মিলে আমার ১৮ বছরের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। আমি এইচএসসিতে স্বনামধন্য একটি কলেজ থেকে খুব ভালো ফল করি। এর পর থেকেই আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। এখন আমি সব সময় সুখে থাকতে চাই। জীবনের একটা মুহূর্তকেও আমি কষ্টের মধ্যে কাটাতে চাই না। কিন্তু আমার এ চাওয়ার পেছনে অতিরিক্ত হাসা, অতিরিক্ত কথা বলা অনেকে অস্বাভাবিক বলে মনে করে।
আমি কি সত্যই পাগল হয়ে যাচ্ছি?
শুভ্র
ঢাকা
পরামর্শ: তুমি আরও চারবার চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পাওনি, সেটি সত্যিই খুব দুঃখজনক। তোমার মতো অনেকেই খুব আশা নিয়ে আমার কাছে অনেক চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় স্থান সংকুলান হয় না বলে বেশির ভাগ চিঠির উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না। আমাকে যে কটি চিঠি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বাছাই করে পাঠানো হয়, আমি সেগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করি। তবে তাদের দিক থেকেও চেষ্টা করা হয়, একটু ভিন্নধর্মী সমস্যাগুলো প্রাধান্য দিতে। তোমার মতো আরও যাদের চিঠির উত্তর এ পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাদের বলছি, ‘আমি সবার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।’ তবে যাঁরা এ পর্যন্ত কষ্ট করে চিঠি লিখেছেন, ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই ‘শেয়ারিং’য়ের মাধ্যমে তাঁরা কিছুটা হলেও মনের ভার লাঘব করে উপকৃত হয়েছেন। এবার আসি তোমার প্রসঙ্গে। এটা খুব আনন্দের কথা যে এইচএসসিতে ভালো ফল তোমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তুমি নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছ। তবে এটা কি সম্ভব যে তুমি কখনোই দুঃখে থাকবে না বা আমাদের সব মুহূর্তই আনন্দে কাটবে? এটাকে কি আমরা বাস্তবসম্মত বা যুক্তিপূর্ণ চিন্তা বলব? খুব ভালো হয় যদি তুমি নিজেকে বাস্তব ভাবনার ভেতর নিয়ে আসতে পারো। জীবনে যদি সব সময় আনন্দ থাকত, তাহলে তো ভালোই হতো, কিন্তু দুঃখ তো জীবনে আসবেই। আমরা যদি সাহসী হয়ে, আমাদের অভ্যন্তরের নেতিবাচক আবেগগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবিলা করে চলতে পারি, তাহলে জীবনটা ততটা কঠিন মনে হয় না।
আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের একটি স্বাভাবিক প্রকাশ ভঙ্গি রয়েছে। ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক প্রকাশের মধ্যে অনেক সৌন্দর্যও লুকিয়ে থাকে। প্লিজ, তুমি বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার হাসি বা কথা বলার সঙ্গে তোমার ব্যক্তিত্বের কোনো অসামঞ্জস্যতা রয়েছে কি না, যা অন্যদের চোখে ধরা পড়ছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে তোমাকে ভেতরের ও বাইরের সত্তার সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে হবে। আর তুমি মোটেও পাগল হয়ে যাচ্ছ না। আত্মবিশ্বাসের সদ্ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আরও ভালো ফল করার প্রতিজ্ঞা নাও।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১০
Leave a Reply