ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ২৯। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। কিছুদিন আগে পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার বাবা হঠাৎ বলে বসলেন, ‘তুমি করবে না, তোমার বাবা করবে?’ এর পর থেকে আমার মনে হতে লাগল, কেন তিনি এ কথা বললেন। আমার আসল বাবা কে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ডিএনএ টেস্ট করানো যায় কি না, তাও চিন্তা করি। আবার মনে হয়, কথাটি আবেগের বশে বলা এবং আপেক্ষিক। কিন্তু প্রশ্নটি মনে হলে দারুণ মনঃকষ্টে ভুগি। আমি কি ডিএনএ টেস্ট করাতে পারব? আমার অবসেশনের সমস্যা আছে এবং একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের অধীন নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি।
নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
ঢাকা।
পরামর্শ: ওষুধের পাশাপাশি তুমি যদি কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সাহায্য নাও, তাহলে অনেক বেশি উপকৃত হবে। থেরাপি গ্রহণের সময় তুমি যদি সাইকোলজিস্ট বা সাইকোথেরাপিস্টের দেওয়া বাড়ির কাজগুলো ঠিকমতো সম্পন্ন করো এবং আন্তরিকভাবে কৌশলগত প্রক্রিয়াগুলোতে অংশ নাও, তাহলে ওষুধ সেবন না করেও অবসেশনমুক্ত থাকতে পারবে। বাবার যে কথাটি নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তায় ভুগছ, সেটি তোমার অবসেশনের কারণেই ঘটছে। তোমার যে সত্তাটি বলছে যে কথাটি বাবা আবেগের বশে বলেছেন, সেটাই আসলে সত্যি কথা। তুমি যে ডিএনএ টেস্ট করানোর চিন্তায় এখন মাঝেমধ্যেই ডুবে যাচ্ছ, এটি কিন্তু তোমার সমস্যার কোনো সমাধান দেবে না। অবসেশনের ক্ষেত্রে একটি দুশ্চিন্তা দূর হলে অন্য একটি দুশ্চিন্তা এসে সেই জায়গা দখল করে নেয়। আর এগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই অসুস্থতার জন্য তুমি কোনোভাবেই দায়ী নও। তবে সঠিক চিকিত্সা নিয়ে সুস্থ হওয়ার দায়িত্বটুকু এখন তোমার নিজেকেই নিতে হবে। তুমি দ্রুত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে সাইকোথেরাপির সাহায্য নাও। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল বা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ‘ক্রিয়া’য় গিয়ে তুমি চিকিত্সা নিতে পার।
সমস্যা: দুই বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র ছেলে। হয়তো এ কারণে তার প্রতি মা-বাবার আচরণটা এমন যেন, ও এখনো স্কুলে পড়ে। অন্যদিকে স্বামীর আয়েই গোটা পরিবার চলে। হাতখরচসহ সংসারের যাবতীয় খরচ আমার স্বামী পৃথকভাবে তার মা-বাবার হাতে তুলে দেয়। সংসারের এ গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও কর্তৃত্ব করতে বা একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। বরং সব ব্যাপারেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান শাশুড়ি, যা আমার ভালো লাগে না। আমার স্বামী আমাকে কিছু কিনে দিলে বা বেড়াতে নিলে তিনি বলেন, ‘কেবল বউয়ের জন্য করে, মায়ের কথা ভাবে না।’ এতে আমার স্বামীও খুব অপরাধবোধে ভোগে এবং সব সময় মায়ের মন রক্ষার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমার কেবলই মনে হয়, বউ হিসেবে আমার কোনো ‘প্রাইভেসি’ নেই, কোনো বিশেষত্ব নেই। ইদানীং স্বামী কিছু কিনে দিতে চাইলে বা বেড়াতে যেতে চাইলে আমার আর আগ্রহ জাগে না, পাছে তুলনা শুনতে হবে ভেবে। অনেকে বলে, সন্তান নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বিতৃষ্ণা ভরা জীবনের প্রভাব কি সন্তানের ওপর পড়ে না?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: মনে হচ্ছে, তোমার স্বামীর ব্যক্তিত্বের গঠন তার বয়সের সঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর সে কারণেই সে তার বাড়িতে তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ছেলেসন্তানদের কাছে অভিভাবকদের প্রত্যাশা অনেক সময় খুব বেশি থাকে। এতে সন্তানদের সব সময় মনে হয়, তারা মা-বাবার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। অভিভাবকেরা যদি আবেগীয়ভাবে আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল হতেন, সন্তানদের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দেওয়ার ব্যাপারে আরও সচেষ্ট হতেন, তাহলে এ ধরনের সমস্যা হতো না। ছেলেসন্তানটি যখন নিজের বিয়ের পর আরেকটি পরিবার তৈরি করে, তখন সে অনেক সময় দুই দিক রক্ষা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করে। একদিকে তার নিজের মা-বাবা, ভাইবোন এবং অন্যদিকে স্ত্রী-সন্তান—এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তার পক্ষে অনেক সময় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। দেখা যায়, সে কোনো পক্ষেরই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। কারণ তার মধ্যে এই সামাজিক কৌশলগুলো ছেলেবেলা থেকে তৈরি হয়নি। ছেলের বিয়ের পর তার মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতাবোধ বা নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, সেটির সঙ্গে মোকাবিলা করে মাকেই কিন্তু এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তোমার শাশুড়ি যদি অবিবেচকের মতো আচরণ করেন, তাহলে বুঝতে হবে সেটি তাঁর সমস্যা। কিন্তু তাই বলে তুমি তোমার অধিকারগুলো ছেড়ে দেবে কেন? স্বামী তোমাকে ভালোবেসে কিছু দিতে চাইলে তুমি অবশ্যই সেটি গ্রহণ করবে। কারণ সেটাই অধিকারচর্চা এবং উপযুক্ত আচরণ। আমার অনুরোধ, তুমি তোমার দায়িত্বগুলো পালন করার পাশাপাশি কিছু সুস্থ বিনোদনচর্চা করবে। লেখাপড়া কতটুকু করেছ জানি না। যদি এখনো কোনো পর্যায় বাকি থাকে, তাহলে আবার পড়াশোনা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উদ্যোগ নাও। যদি সম্ভব হয়, তাহলে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সুন্দরভাবে তোমার কিসে কষ্ট ও আনন্দ হয়, তা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করো। আমি তোমার প্রশংসা করছি এ কারণে যে তুমি বুঝতে পেরেছ, সন্তানের ওপর তোমার বিষণ্নতার প্রভাব পড়বে এবং একটি সন্তানকে জীবনে নিয়ে আসা এই পরিস্থিতিতে কোনো সমাধান নয়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৮, ২০১০
Leave a Reply