ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ৩০। ব্যক্তিগত জীবনে আমি আগে মা-বাবা, ভাইবোন ও বিয়ের তিন-চার বছর পর্যন্ত সুখী ছিলাম। শিক্ষাজীবনেই এইচএসসিতে বাবা ও বিএ (অনার্স)-এ মা মারা যান। ভালোবেসে বিয়ে করি। বর্তমানে দুটি মেয়েসন্তানের মা। স্বামী প্রথমে বেকার ছিল, এখন সফল ব্যবসায়ী। প্রথম জীবনে আমার স্বামী আমাকে খুবই ভালোবাসত এবং সাংসারিক সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। তাঁর সহযোগিতায়ই আমি এমএ করি ও বর্তমানে চাকরি করছি।
আমার সমস্যাটা হলো, বর্তমানে আমার স্বামীর সঙ্গে আমার বনিবনা হচ্ছে না। সে আমাকে বুঝতে চায় না, আমাকে মূল্যায়ন করে না। সে তাঁর পরিবারের বড় ছেলে। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর বিশাল সম্পত্তি সে দেখাশোনা করে। বিনিময়ে মা, ভাইবোনদের দেখাশোনা করে। আমার স্বামী আমার চাকরির টাকা নেয় না। আমি সংসারে বিভিন্ন প্রয়োজনে ও সংসার সাজাতে তা খরচ করি।
আমার স্বামী বাজার করে। তবে সংসারের বিভিন্ন ব্যাপারে উদাসীন। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে করতে হয়। এ নিয়ে প্রায়ই দ্বন্দ্ব হয়। এ ছাড়া আমার ছোট মেয়েকে কাজের লোকের কাছে রেখে যাই। আমার স্বামী আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। এ নিয়েও দ্বন্দ্ব হয়। ইদানীং স্বামীর সঙ্গে আমার ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। আমি মাঝেমধ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি এবং আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগে। সংসারে বাচ্চাদের মারধর করি। কাজের লোককে বকাঝকা করি। চিৎকার চেচামেচি করি এবং অনেক সময় মন খারাপ হয়ে একাকিত্বে ভুগি। জীবনকে অসহ্য মনে হয়। আমি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চাই। স্বামী-সন্তানদের জন্য জীবন সফল করতে চাই। এ জন্য আপনার সাহায্য কামনা করছি।
প্রীতি
যশোর।
পরামর্শ: তোমাদের বিয়ের বয়স এখন কত এবং সন্তান দুটো কোন বয়সে রয়েছে, তা উল্লেখ করোনি। বোঝা যাচ্ছে, বিয়ের পর তোমার স্বামীর ব্যবসায়িক সাফল্য এসেছে এবং তুমিও এমএ পাস করে চাকরি করছ। দুটো খুবই ইতিবাচক ঘটনা থাকা সত্ত্বেও তোমাদের মধ্যে সারাক্ষণ মতানৈক্য হচ্ছে কী কারণে, তা মনে হয় খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বিয়ের পরপর তোমরা পরস্পরকে হয়তো অনেক সময় দিতে পেরেছ এবং তখন ভালোবাসার প্রকাশও বেশি ঘটেছে। তবে একটা সময়ের পর দেখা যায়, সংসারজীবনে এবং পেশাগত জীবনে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার ফলে দম্পতিরা নিজের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার প্রয়াসটি অব্যাহত রাখতে পারে না। তুমি তোমার লেখাপড়া, চাকরি, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়েছ এবং স্বামীও তার ভাগ্য গড়তে আর তার নিজের পরিবারের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে সংগ্রাম করেছে। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে ছেলেসন্তানদের কাছে তার পরিবারের অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকে বলে তারা বিয়ের পর স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি অনেক সময় পুরোপুরি মনোযোগী হতে পারে না। এতে অনেক টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটাই বাস্তবতা। ছেলেসন্তানদের পরিবার যদি আরও বেশি বিবেচক হতো এবং বিয়ের পর তাদের ছেলেকে কিছুটা ছাড় দিত, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবন অনেক সুখের হতো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, জীবনের নেতিবাচক দিকগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইতিবাচক দিকগুলো বেশি করে দেখো। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে তোমরা যে দুটো সন্তান উপহার পেয়েছ, তাদের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের মা-বাবার সুখী দাম্পত্য জীবন এবং বাড়িতে একটি আনন্দময় পরিবেশ। তোমার কষ্টার্জিত আয়ের অর্থ দিয়ে বাড়ি সাজানোর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে তোমার আর স্বামীর সুন্দর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য। কারণ তোমার মনের অশান্তি কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই সন্তানদের মনের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বাড়িতে শান্তি আনার জন্য সবটুকু দায়িত্ব স্বামীর ওপর না দিয়ে তুমি এ ব্যাপারে কী কী অবদান রাখতে পারো, তা বেশি করে ভাববে, কেমন? এটি করার জন্য তোমার নিজের পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টি, সুস্থ বিনোদন, বিশ্রাম, ব্যায়াম—এই জিনিসগুলো জীবনচর্চায় অবশ্যই রাখতে হবে। ভেবে দেখো, চাকরি করার ফলে তুমি আরও বেশি মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছ কি না। তা যদি হয়, তবে কিছুদিন ছুটি নিয়ে তোমাকে আবেগীয় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বামী মূল্যায়ন না করলেও কিন্তু তুমি নিজের প্রতি শ্রদ্ধা হারাবে না। তোমার ভালো গুণাবলি, অর্জন, কঠিন পরিশ্রম করার ক্ষমতা মাথায় রেখে নিজেকে আরও ভালোবাসতে চেষ্টা করো। স্বামীর কাছ থেকে প্রত্যাশা কিছুটা কমিয়ে রাখলে দেখবে একটু স্বস্তি লাগবে। এ ছাড়া তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে বসে দুজনে মিলে ঠিক করো, তোমরা পরস্পরের কাছে কী কী প্রত্যাশা করো। যদি দেখা যায়, কিছু কিছু প্রত্যাশা তোমরা পূরণ করতে পারবে, তাহলে সেই লক্ষ্যে দুজনই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করো। তবে কোনো প্রতিযোগিতার ভাব মাথায় না রেখে সততার সঙ্গে এটি করতে হবে।
আর কিছু প্রত্যাশা যা একেবারেই পূরণ হওয়ার নয়, সেগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের পারস্পরিক সমঝোতায় আসতে হবে। তবে তোমার এই ধ্বংসাত্মক আচরণ যদি চলতেই থাকে, তাহলে অবশ্যই তোমাকে সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে হবে। এ বিষয়ে তোমার সচেতনতার জন্য এবং আমাকে লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আশা করব, তুমি নিজের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল হয়ে বিষণ্নতা থেকে বেরিয়ে আসবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৭, ২০১০
Leave a Reply