হাঁটি হাঁটি করে তৈসিফের বয়স হলো দুই বছর। কথা তেমন একটা বলতে পারে না। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বলে বাবা, বুবু, মা, কাকা আর বিশ্বকাপ ফুটবলের বদৌলতে চাচার কাছ থেকে আর্জেন্টিনা বলাটা শিখেছে। তৈসিফের ভবিষ্যৎ আর পড়ালেখা নিয়ে এরই মধ্যে ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন তাঁর বাবা-মা। পরশের অধিকাংশ খেলার জিনিসই পড়ালেখাকেন্দ্রিক। মা-বাবা দুজনই কর্মজীবী হওয়ায় কেউই বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। কীভাবে একটি ভালো স্কুলের জন্য সন্তানকে গড়ে তুলবেন, সেই চিন্তা তাঁদের দিশেহারা করে দিচ্ছে।
বিকেলে অফিস থেকে বাসায় ফিরলেই ঝাঁপ দিয়ে বাবার কোলে চড়ে অনন্য। এরপর বুক পকেট থেকে কলম ছিনিয়ে নিয়ে নিজের মনের মতো ক্যানভাস তৈরি করে বাড়িজুড়ে চলবে তার আঁকিবুঁকি। সন্তানের এই উৎসাহকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে অনন্যর বাবা-মা সন্তানকে এনে দিয়েছেন ছবি আঁকার খাতা। আর এই অর্থহীন আঁকিবুঁকির সময়ও সন্তানের হাতের কলমটি যেন সঠিকভাবে ধরা হয়, সে দিকে তীক্ষ দৃষ্টি অভিভাবকের। যেন শুরু থেকেই একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় আগামী দিনের ভবিষ্যতেরা। শুধু কি তাই, সন্তানকে গান, নাচ, কবিতা, সাঁতার আর খেলাধুলাতেও পারদর্শী করতে সচেষ্ট এখানকার মা-বাবারা।
এখানেই শেষ নয়। সব অভিভাবকই চান সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে। কিন্তু সেটি তো আর সহজ কাজ নয়! রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে শিশুদের প্রমাণ করতে হয় নিজের যোগ্যতা, যার নাম হলো ভর্তিযুদ্ধ। গত বছর এই ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে স্বনামধন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি ইরা। পরবর্তী ভর্তিযুদ্ধের জন্য মেয়েকে প্রস্তুত করতে সদা ব্যস্ত ইরার মা। সকালে গৃহশিক্ষক, বিকেলে কোচিং আর রাতে নিজেই পড়ান মেয়েকে। কার্টুন দেখা, খেলা—সবই বাদ পড়েছে পরীক্ষার অজুহাতে। এত চাপে দিশেহারা হয়ে পড়ে কোমলমতি শিশুরা। জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে চৌকস করতে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। বর্তমান সময়ে অবিভাবকেরা ভালো করে কথা বলা শিখতে না শিখতেই বই ধরিয়ে দিচ্ছেন সন্তানের হাতে। এ ফর আপেল, বি ফর বল, সি ফর ক্যাট শেখাতেই ব্যস্ত তাঁরা। এ ছাড়া ছবি আঁকা, গুনতে শেখা তো আছেই। যে বয়সে শিশুরা ব্যস্ত থাকবে নিজের খেয়ালে আর ইচ্ছেমতো দাগ কাটবে দেয়াল ভরে, সে সময় তাকে আঁকতে বলা হচ্ছে চারকোনা বাক্স আর সরলরেখা। একটিবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই প্রতিযোগিতায় শিশুরা আদৌ প্রতিযোগী হতে পারবে কি না? কখনো কি বুঝতে চেয়েছি এই শিশুদের মনের অবস্থা? সন্তানকে কতটুকুই বা সময় দিচ্ছেন কর্মজীবী বা ব্যস্ত অভিভাবকেরা?
সানিডেল স্কুলের অধ্যক্ষ তাজিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা সব সময় শিক্ষার্থীর বাবা-মাকে বলি বাচ্চাকে পর্যাপ্ত সময় দেবেন। যাকে আমরা বলি কোয়ালিটি টাইম। আর ইংরেজি মাধ্যমে বাচ্চাকে পড়াতে গেলে একটু বেশি সময় দিতে হবে, কেননা বিদেশি ভাষা বোঝার জন্য বেশি সময় দিতে হয়। বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির আগে সব কিছু পড়িয়ে পণ্ডিত বানিয়ে আনতে হবে—এমনটা আমরা কখনোই বলি না। আমরা লক্ষ করি, বাচ্চাকে যে চকলেট দেওয়া হয়েছে, তা সে বাবা-মা বা অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করছে কি না। অর্থাৎ বাচ্চারা শেয়ারিং শিখছে কি না, কলম বা পেনসিল ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছে কি না। প্লে গ্রুপে ভর্তি হওয়ার পর বাচ্চারা যা শেখে তা হলো, সোশাল অ্যাডজাস্টমেন্ট বা সামাজিক আচরণ। কিছু কিছু আচরণ আমরা শিশুকে শেখাই; যেমন—সকালে গুড মর্নিং বলা, গুরুজনের গায়ে পা লাগলে সরি বলা, ক্লাস শেষে গুড বাই বলা ইত্যাদি। অনেক শিশু এসব শিষ্টাচার ও ভদ্রতা বাড়ি থেকেই শিখে আসে। মোদ্দাকথা, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে যা যা দরকার, তা-ই আমরা শিশুকে শেখাই। পাশাপাশি শিশুর পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা প্রয়োজন, কারণ বাচ্চারা এটা চায়।’
তাজিন আহম্মেদ আরও বলেন, ‘একবার আমরা ছোট বাচ্চাদের বলেছিলাম চিঠি লিখতে। এক বাচ্চা লিখেছিল, “বাবা অফিস থেকে এসে টেলিভিশন নিয়ে বসেন আর মা টিভিতে সিরিয়াল দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। হে আল্লাহ, আমাকে টিভি বানিয়ে দাও। যাতে করে সবাই আমার দিকে মনোযোগ দেয়”।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমা খাতুন বলেন, ‘বাবা-মাকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা একটি শিশুর কাছ থেকে কতটুকু আশা করতে পারি। সন্তান তথাকথিত ভালো স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে এটা নিয়ে বাবা-মা আশাহত হন। এর ফলে হীনম্মন্যতায় ভোগে শিশু। সে ভাবে, তাকে দিয়ে হয়তো কিছুই হবে না। বাবা-মায়ের উচিত শিশুর আগ্রহের দিকে মনোযোগ দেওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিশুর বিকাশটা হয় চারটি ধাপে। ধাপগুলো হলো যথাক্রমে আবেগীয় বিকাশ, বৌদ্ধিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ এবং নৈতিক বিকাশ। তিন-চার বছর বয়সে শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশ হয়। এই সময় শিশুর ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে তাকে বোঝাতে হবে। হয়তো খেলনাটা ভেঙে সে কিছু আবিষ্কার করতে চাইবে। এই সুযোগটা শিশুকে দিতে হবে। এই বয়সে শিশুকে ধমক না দিয়ে বলতে পারেন, এটা কোরো না বা এটা এভাবে কোরো। অর্থাৎ সব কিছু করতে হবে শিশুকে প্রশ্ন করে, তাকে বুঝিয়ে বা আস্থায় নিয়ে। কখনো চাপিয়ে দিয়ে নয়।’
শারমিন নাহার
মডেল: সেঁওতি ও আরানা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৩, ২০১০
Leave a Reply