ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: প্রায় দুই বছর আগে থেকে, মেয়েদের নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করি ও মুঠোফোনে খুব বেশি কথা বলি। আমার চিন্তাশক্তি অনেক প্রখর। আমি দুই বছর ধরে প্রায় প্রতি রাতে এমনকি দিনের বেলায় ঘুমালেও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো বেশির ভাগ মেয়েদের নিয়ে। এখন আর মেয়েদের নিয়ে তেমন ভাবি না। এমন অনেক স্বপ্ন দেখি, যা কখনো চিন্তাও করি না। এ সমস্যা আমাকে গভীর দুশ্চিন্তার ফেলে দিয়েছে। ফলে আমি পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। প্রায় নয় মাস ধরে মুঠোফোনে অতিরিক্ত কথা বলা বন্ধ করেছি, তবুও অবস্থার কোনো উন্নতি দেখছি না।
প্রণব
পরামর্শ: তুমি তোমার সমস্যাটি অকপটে প্রকাশ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমাদের দেশে, ছোট বয়স থেকে ছেলে ও মেয়েদের সুস্থ, স্বাভাবিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না বলে বয়ঃসন্ধিতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অতিরিক্ত কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এই বয়সে কিশোর-কিশোরীরা নানা ধরনের ম্যাগাজিন, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি দেখে বলে আগ্রহের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এখন মুঠোফোন বা ইন্টারনেটের মাধ্যমেও বেশ কিছু অসুস্থ চর্চা চলছে। এসব কারণে তোমার মনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। আর সে কারণেই ঘুমের মধ্যে অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটছে। যেহেতু ব্যাপারটা অবচেতনমনের প্রভাবে হচ্ছে, তুমি চেষ্টা করলেও স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারবে না। তবে এটি নিয়ে জাগ্রত অবস্থায় বেশি দুশ্চিন্তা করলে বা নিজেকে ধিক্কার দিলে বরং কষ্ট আরও বাড়বে। কারণ কোনো কিছুর জন্য মনের ওপর জোর করলে সেটি আরও বেশি চেপে বসে। এটিকে খুব অস্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা না করে তুমি জীবনের সুস্থ চর্চাগুলো করে যাও। যা যা করলে নিজেকে শ্রদ্ধা করতে পারো, এমন বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করো।
মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে, তাদের তোমার মতোই আরেকজন মানুষ হিসেবে দেখো। মুঠোফোনে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে একজন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে যেমন কথা বলো, ঠিক তেমনিভাবে মেয়েদের সঙ্গেও দুজনের সম্মান রেখে কথা বলো। নিজেকে এ কারণে ছোট না ভেবে জেগে থাকার সময়গুলোতে লেখাপড়া ও অন্যান্য সুস্থ কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকো।
সমস্যা: আমি সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে পারি না, আবার নিজেই সবার থেকে দূরে থাকি। ঢাকার নামকরা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছি। এসএসসিতে ভালো করার কারণে সবার আশা ছিল এবারও ভালো করার। আমার চেয়ে আমার পরিবারই বেশি হতাশ; কিন্তু আমার বেশি আক্ষেপ নেই। গত ছয়-সাত মাসে আমি একটি পাতাও মনোযোগ দিয়ে পড়িনি। কোচিংয়ে ভর্তি হলেও বেশির ভাগ সময়ই আমি যাইনি। মিথ্যা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এখন সময়টা আমার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি নির্বিকার, মাঝেমধ্যে অস্থির, হিংস্র আচরণও করি। মরে যাওয়ারও চেষ্টা করেছিলাম। আমি বড়দেরও ব্যাপারটা বলেছি, কিন্তু তারা হালকাভাবে নিয়েছে অথবা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আমি আবার ফিরে আসতে চাই, নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চাই।
মনমোহিনী
পরামর্শ: আমাদের বিষণ্নতা সাধারণত দুভাবে হতে পারে। একটি হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন, যা বিশেষ কোনো কারণ বা ঘটনা থেকে সৃষ্টি হয় না। দেখা যায়, একেবারে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার মতো কারণ ছাড়া প্রায়ই মন খারাপ থাকছে এবং আমরা সবকিছুর প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। এ সময় কারও সঙ্গে মিশতে, বাইরে যেতে, নিজের যত্ন নিতে আমাদের একেবারেই ইচ্ছে করে না। দ্বিতীয় ধরনের বিষণ্নতা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে সৃষ্টি হয়। এটি সময়ের সঙ্গে বা থেরাপির সাহায্য নিলে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ ছাড়া শৈশব থেকে খুব বেশি প্রতিকূল অবস্থায় বড় হলে কিছু মানুষ সমাজ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়। তাদের মধ্যে বিষণ্নতার অনেক উপসর্গ দেখা যায়। পরিবারের সদস্যরা আমাদের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করলে আমরা যখন সেগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হই, তখনো বিষণ্নতা সৃষ্টি হতে পারে। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন হলে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যের অভাব ঘটে বলে ওষুধ ও সাইকোথেরাপি দুটোই প্রয়োজন হয়। আর যদি পরিবেশগত কারণে আমরা বিষণ্নতায় ভুগি, তাহলে বেশ কয়েকটি সাইকোথেরাপি সেশনের মাধ্যমে সুস্থ হওয়া যায়। পরিবারের অন্যরা তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছে না। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একেবারেই সচেতন নয়।
তুমি তোমার ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চাইছ এবং সুস্থ জীবন যাপন করতে চাও। সেটি পরিবারের কাউকে অন্তত খুব ভালোভাবে বোঝাও। তারা কেউ সাহায্য করলে খুব ভালো হয়। আর তা না হলেও তুমি অবশ্যই ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে যেকোনো দিন বা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সোমবার সকালে গিয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের সঙ্গে দেখা করে তোমার অসুবিধাগুলো বলতে পারো।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ৩১, ২০১০
Leave a Reply