বাংলাদেশেই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে বিদেশের সুস্বাদু ড্রাগন ফল। পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বড় বড় চেইন শপে। লোকমুখে খবরটা শোনার পর নিজের চোখে বাগান ঘুরে দেখার আগ্রহ জাগল। ঢাকা থেকে খুব একটা দূরের পথও নয়, সাভারে অবস্থিত এ প্রকল্পটি।
ড্রাগন ফল
নামটা শুনে যে কারও খটকা লাগাই স্বাভাবিক! এ আবার কেমন ফল? ড্রাগন! নাম শুনেই মনে পড়ে হিংস্র জন্তুর কথা। ভাবতে পারেন, নিশ্চয়ই এর সঙ্গে রূপকথার সেই ড্রাগন নামের প্রাণীটার কোনো না কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে। নামের মিল না খুঁজে বরং আপনাদের জানিয়ে দিই এ ফলের আসল রহস্যটা!
ড্রাগন নামের এ ফলটি গোলাকার বা ডিম্বাকার হয়ে থাকে। রং উজ্জ্বল গোলাপি ও লাল। ভেতরের শাঁস সাদা ও লাল—দুই রঙেরই হয়। শাঁসের মধ্যে ছোট ছোট কালিজিরার মতো দেখতে নরম অনেক বীজ থাকে। আর ফলের স্বাদটা হলো হালকা মিষ্টি ও রসাল। ফলের খোসার ওপর আনারসের মতো আঁশ হয়। দেখতে অনেকটা যেন ‘নাইটকুইন’ ফুলের মতো। গাছ লতানো ক্যাকটাসের মতো। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক এম এ রহিম জানান, এর বৈজ্ঞানিক নাম Hylocereus sp। আবাসস্থল মধ্য আমেরিকায়। তবে এ ফলের চাষাবাদ বেশি হয় থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাতিন আমেরিকায়। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াবাসীর কাছে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল, বিশেষ করে রস বানিয়ে খাওয়ার জন্য।
দেশের মাটিতে বিদেশি ফল
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দু-একটি জায়গায় ড্রাগন ফলের চাষ হচ্ছিল। এখন বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ করা হচ্ছে ঢাকার সাভারের জিরানীতে। এ প্রকল্পটির নাম ‘এল আর এগ্রো ফার্মস’।
প্রকল্প শুরুর পেছনের কথা
দেশের মাটিতে নতুন একটা কিছু করার ভাবনা অনেক দিন ধরে মাথায় ছিল রুম্পা চক্রবর্তীর। তাঁর শিক্ষক থাই নাগরিক বাল কিষান কায়ানের ব্যাংকক ও ইন্দোনেশিয়ায় আছে ড্রাগন ফলের বাগান। ওই বাগান দেখে বাংলাদেশে ড্রাগন ফলের চাষ করার ইচ্ছা জাগে তাঁর। তাঁর সঙ্গে এ কাজে যোগ দেন ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান। শুরুতে থাই নাগরিক বাল কিষান কায়ান প্রথমে জমি ঘুরে দেখেন, পরীক্ষা করেন মাটি। তারপর ২৫টি গাছ নিয়ে শুরু পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ। ভালো ফলাফল আসে। তার পরের গল্প—ঝুঁকির পথে পা বাড়ানো। থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ায় ড্রাগন ফলের বাগান ঘুরে ঘুরে উন্নত মানের চারাগাছ সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিশেষ উপায়ে আনা হয় ১৬ হাজার ড্রাগন ফলের চারাগাছ। রোপণ করা হয় গত বছরের জুনে। শুরু হয় ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ।
উৎকণ্ঠা ও মুখে হাসি!
প্রথম বছরটি উদ্যোক্তারা কাটিয়েছেন নানা অনিশ্চয়তায়। গাছ লাগানোর পর দরকার পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের। কিন্তু প্রকৃতি এমনই বিরূপ যে গাছ লাগানোর পর গত বছর বৃষ্টিপাত হয়নি বললেই চলে। হলুদ হয়ে যাচ্ছিল গাছগুলো। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম আর একাগ্রতার জোরে সেই অনিশ্চয়তা ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছেন রুম্পা। হঠাৎ কোনো সমস্যা দেখা দিলে কায়ানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সমাধান করে নেন তাৎক্ষণিক। আজ এক বছর হতে চলল। এবার সময়মতো বৃষ্টি এল। সেই সঙ্গে গাছে এল ফুল। জুনের মাঝামাঝি ফল পাকতে শুরু করল। সেই পাকা ফল নিয়ে রুম্পা চলে যান সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। পরীক্ষা করান ফলের খাদ্যগুণ। ফলাফল দারুণ। প্রকল্পের শুরুতেই এত বেশি ফলন এসেছে, যা দেখে অবাক হয়েছেন থাই নাগরিক বাল কিষান কায়ানও।
চোখ জুড়ানো ফলের বাগান
প্রকল্পের চারদিকে সবুজের বেষ্টনী। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই নানা পাখির কলকাকলি। ডান দিকে ড্রাগন ফলের চোখ জুড়ানো এক বাগান। এই ১০ একর জমির ওপর সারি সারি চার হাজার সিমেন্টের খুঁটি পোঁতা। প্রতিটি খুঁটিতে লাগানো চারটি করে গাছ। সারি সারি গাছের ফাঁক দিয়ে হেঁটে গেলে চোখে পড়ে ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত গাছের কোথাও ফুটে আছে ড্রাগন ফলের প্রস্ফুটিত ফুল আর কোথাও বা পাকা লাল টুকটুকে ফল। এল আর এগ্রো প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক জানান, এ গাছগুলোর কাঁটা ফেটে বের হয় ছোট্ট ফুল, ফোটে আট থেকে দশ দিনের মধ্যে। ফোটা ফুলের গন্ধটাও কেমন যেন মাদকতাময়। এই ফুল চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে ঝরে গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী হয়। আসল সৌন্দর্যটা ধরা পড়ে ফল পাকলে।
ড্রাগন ফলের পুষ্টিগুণ
সায়েন্স ল্যাবরেটরির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বরুণ কান্তি সাহা বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম ড্রাগন ফলে ৬৫ কিলোক্যালরি খাদ্যগুণ পাওয়া গেছে। এর পুষ্টিগুণ অনেক। আছে প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ জানান, ড্রাগন ফল খেলে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে ডায়াবেটিসের রোগীরা অনায়াসে এই ফল খেতে পারেন, কিন্তু অন্যান্য মিষ্টি ফলে এই সুবিধা পাওয়া যায় না। এ ফল হজমে সহায়তা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে। বিশ্বের নানা মেডিকেল জার্নালে এর পক্ষে তথ্য দেওয়া আছে।
সফলতার পথে এক ধাপ
এল আর এগ্রো প্রকল্পে প্রথম ড্রাগন ফল ধরার পর রুম্পা চক্রবর্তী এ নিয়ে বিভিন্ন চেইন শপের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। জুনের মাঝামাঝি প্রথমে হাটবাজার ও আগোরায় পৌঁছে যায় ফল। এল আর এগ্রোর অন্যতম উদ্যোক্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘ড্রাগন বিদেশি ফল সত্য, কিন্তু দেশে যেভাবে ফলেছে আর মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে ফলটি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।’ রুম্পা চক্রবর্তী বলেন, এ পর্যন্ত তিন দফায় ১০০ কেজির বেশি ফল তোলা হয়েছে। গাছ যত পরিপক্ব হবে, উৎপাদন তত বাড়তে থাকবে।
যেখানে মিলছে ড্রাগন ফল
এই ফল প্রতি কেজি ৩৭৫ টাকা করে আগোরার গুলশান ও ধানমন্ডি আউটলেট এবং হাটবাজার চেইন শপের ধানমন্ডি শাখায় পাওয়া যাচ্ছে। শিগগিরই ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্যান্য চেইন শপে এ ফল সরবরাহ করা হবে বলে জানান রুম্পা চক্রবর্তী।
মোছাব্বের হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০১০
Leave a Reply