একটু আগেই বৃষ্টিটা থেমেছে। কিন্তু আকাশে তখনো কাজল কালো মেঘ। আর নিচে বসুন্ধরার বুকে একরাশ সবুজের ঝোপে একঝাঁক অলকানন্দা ফুল। সোনারং ঘণ্টার মতো সেসব ফুলের পাপড়িতে লেগে আছে বৃষ্টির কণা। দিনের যতটুকু আলো আছে, সে আলেতেই চমকাচ্ছে ওই জলকণাগুলো। হাওয়ায় দুলছে অলকানন্দার ফুল। জোলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের সুর, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে/ চেনা শুনার কোন বাইরে/ যেখানে পথ নাই নাইরে/ সেখানে অকারণে যাই ছুটে।’ বৃষ্টি ছিল, তাই বাইরে বেরোনো বন্ধ। কিন্তু ফুলেল মন নিয়ে ফুলেদের কাছে যেতে বাধা নেই। জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখা, উদাস হয়ে রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টির গান শোনা অথবা বই পড়া, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া, সঙ্গে কুড়মুড় কুড়মুড় কিছু একটা খাওয়া। বাদল দিনে এ যেন কল্পনার ও স্বপ্নের একটা ক্ষণ। প্রকৃতির সঙ্গে বাদল দিনে এমন একাত্ম হতে কার না মন চায়। কিন্তু চাইলে কি সব হয়? এসব হতে গেলে জানালা খুললেই যাতে বাড়ির আঙিনায় এক ফালি ফুলের বাগান চোখে পড়ে, তার ব্যবস্থা তো করা চাই। সে বাগানে বাদল দিনে শুধু অলকানন্দাই ফুটবে না, ফুটবে সুগন্ধ বিলানো বেলি থেকে নাইটকুইন পর্যন্ত।
বৃষ্টিদিনের ফুলগুলো
কদমের পালকিতে চড়ে এ দেশে বর্ষা আসে। কদম ফোটা শুরু মানেই বর্ষার আগমনী বার্তা। এরপর একে একে ফুটতে থাকে অলকানন্দা বা অ্যালমন্ডা, বেলি, মোরগজবা, মোরগঝুঁটি, দোপাটি, বোতামফুল বা গমফ্রেনা, হলুদ কসমস, ছোট সূর্যমুখী, টিথোনিয়া, টেরোনিয়া, সন্ধ্যামণি, বর্ষার জিনিয়া, কলাবতী, নানা জাতের হেলিকোনিয়া ও বার্ড অব প্যারাডাইস, মালতীলতা, ফুরুস, নাইটকুইন, মনসা বা ইউফরবিয়া, রেইন লিলি বা ডে লিলি, স্পাইডার লিলি, জবা, রজনীগন্ধা, নয়নতারা, গেলার্ডিয়া, হাইড্রেনজিয়া, কামিনী ইত্যাদি। গ্রীষ্মে ফোটা শুরু হলেও স্বর্ণচাঁপা ও অশোকের প্রস্ফুরণ বর্ষাতেও চলতে থাকে। এ দেশে নতুন আসা ক্ল্যামেটিস জুঁইও বর্ষাতে বেশ ভালো ফুটছে।
ফুলগাছ লাগানোর জায়গা
ভালো হয় বাড়ির আঙিনায় কোনো এক চিলতে ফাঁকা জমিনে গাছগুলো লাগাতে পারলে। বড় ও স্থায়ী গাছ বিশেষ করে কদম, স্বর্ণচাঁপা, আশোক ইত্যাদি গাছ অবশ্যই জমিনের বাগানে লাগাতে হবে। অন্য গাছগুলো টবে ও জমিনে দুই জায়গাতেই লাগানো চলে।
ফুলগাছ সংগ্রহ
পছন্দসই ফুলগাছ লাগাতে চাইলে আগে সেটাকে চিনতে হবে। চেনার জন্য এ সময় বিভিন্ন নার্সারি ঘুরে দেখতে পারেন। নার্সারিগুলোতে অধিকাংশ বর্ষার ফুল ফোটা গাছের দেখা পেতে পারেন। নাম বললেই তাঁরা সেটি দেখিয়ে দেবেন। চেনার সঙ্গে পছন্দটাও যাচাই করে নিতে পারেন। পছন্দ হলে সেখান থেকে গাছ সংগ্রহ করে নিতে পারেন। পলিব্যাগের চারা কেনাই ভালো। এতে পছন্দমতো যেকোনো জায়গায় চারা লাগাতে পারেন। তবে এখনই ফুলের দেখা চাইলে টবে লাগানো বড় গাছও সংগ্রহ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে লক্ষ রাখবেন, কিছুদিন ধরে ফুটতে পারে এমন কুঁড়ি যেন গাছে থাকে। চারার জন্য খোঁজ নিতে পারেন ঢাকার ফার্মগেটের কাছে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট চত্বরের নার্সারিগুলোতে, দোয়েল চত্বরের ফুটপাতের চারার দোকানগুলোয়, গুলশান ১ নম্বরের ব্র্যাক নার্সারিতে।
লাগানোর উপযুক্ত সময়
যেকোনো গাছ লাগানোর জন্য বর্ষাই উপযুক্ত সময়। এ সময় লাগানো গাছ সহজে মরে না। গাছে জলও ঢালতে হয় না। বিকেলের দিকে চারা লাগালে লাগানোর পরপরই গাছ ঢলে পড়ে না।
যেভাবে লাগাবেন
জমিতে হলে আগে লাগানোর জায়গা ঠিক করতে হবে। কিছু আছে মৌসুমি স্বভাবের গাছ। এ মৌসুমে ফুল দিয়েই গাছ মরে যাবে। আর কিছু গাছ আছে, যেমন হেলিকোনিয়া, নাইটকুইন, মালতীলতা, কদম ইত্যাদি কয়েক বছর বাঁচবে। সেগুলো এমন জায়গায় লাগাবেন, যেখান থেকে পরে যেন গাছ আর সরাতে না হয়। টবের জন্য কোনো চিন্তা নেই। জায়গা ঠিক করে সেখানে গর্ত করে গর্তের মাটির সঙ্গে আধাআধি পরিমাণ পচা গোবর সার বা গর্তপ্রতি ২০০ থেকে ৫০০ গ্রাম প্যাকেটের কম্পোস্ট সার মিশিয়ে মাটি ভরাট করে সপ্তাহখানেক রেখে দেবেন। টবের মাটির সঙ্গে প্যাকেটের কম্পোস্ট সার একইভাবে মিশিয়ে টব ভরবেন। টবের নিচে এক ইঞ্চি পুরু করে কাঠকয়লা বা ইটের কুচি বিছিয়ে দেবেন। টবের তলার ছিদ্রের মুখ বন্ধ করা চলবে না। প্রতি টবে একমুঠ হাড়ের গুঁড়াও মিশিয়ে দিতে পারেন। এরপর গর্তে বা টবের মাঝখানে চারাটি লাগিয়ে গোড়ার মাটি চেপে দেবেন। মাটি শুকনো থাকলে লাগানোর পর গোড়ায় একটু জল দেবেন। টবেও একইভাবে লাগাবেন। তবে লাগানোর আগে অবশ্যই পলিব্যাগটা কেটে বাদ দেবেন। গাছ লম্বা থাকলে অবশ্যই গাছের পাশে একটি কাঠি এর সঙ্গে বেঁধে দেবেন।
ফুলগাছের যত্ন
টবে বা জমিতে চারা লাগানোর পর তা ঢলে না পড়লে এবং কয়েক দিন পর নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করলে বুঝতে হবে গাছটা বেঁচে গেছে। তিন-চার পাতা ছাড়ার পর গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে চারপাশে ঘুরিয়ে হালকা করে মাটি খুঁড়ে বা নিড়িয়ে গাছ বুঝে অল্প সার দেওয়া যেতে পারে। টবের গাছে সার দেওয়ার বিশেষ দরকার পড়ে না। গাছের চেহারা দুর্বল মনে হলে এক লিটার পানিতে এক চা-চামচ ইউরিয়া সার গুলে একটা টবে পাঁচ-সাত দিন পরপর দুই থেকে তিনবার দেওয়া যেতে পারে। বেয়াড়া ডালপালা ছেঁটে গাছকে সুন্দর করে রাখতে হবে। মরা ও শুকনো ফুল গাছ থেকে ফেলে দিলে ভালো দেখাবে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০১০
Leave a Reply