ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: সমস্যাটি আমার বাবার। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি। তিনি মাঝেমধ্যে ঘুম থেকে ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন। কোনো কোনো সময় ঘরের বেড়ায় সজোরে ঘুষি মারেন। হাত কেটে রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাঁর হার্টের সমস্যা এবং হাই ব্লাড প্রেশার আছে।
মেহরাফ হাসান
মুন্সিগঞ্জ
পরামর্শ: বাবা যখন এই বয়সে প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত আছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে, শারীরিকভাবে তিনি এখনো মোটামুটি ভালোই আছেন। তবে ঘুম থেকে এভাবে চিৎকার করে উঠে যদি হাত কেটে রক্তাক্ত করে ফেলেন, তাহলে কখনো বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। বিষয়টি কবে থেকে ঘটছে, তাঁর এ ধরনের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল কি না, স্বপ্নটি পরবর্তী সময়ে মনে থাকে কি না, এ তথ্যগুলো জানা প্রয়োজন ছিল। অনেক সময় শৈশবে ঘটে যাওয়া ভীতিকর স্মৃতিগুলো আমাদের অবচেতন মনে স্থান নেয় এবং জীবনের কোনো সংকটময় সময়ে সেগুলো আমাদের পীড়া দেয়। তুমি বাবাকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি বিভাগে অথবা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসো। সেখানে কর্মরত সাইকোথেরাপিস্ট তোমার বাবাকে কাউন্সেলিং সেবাদান করার পাশাপাশি তোমাকে যদি মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিতে বলেন, তাহলে তাঁকেও দেখিয়ে নেবে, কেমন?
সমস্যা: আমি একজন কলেজশিক্ষক। বিয়ে হয়েছে সাত বছর। ছেলের বয়স পাঁচ বছর, মেয়ের বয়স এক বছর। আমাদের বিয়ের এক বছরের পর থেকে সংসারে অশান্তি চলছে। আমার স্ত্রী অত্যধিক আবেগপ্রবণ ও বদমেজাজি। আমার শ্বশুরের দুটি বিয়ে হয়েছিল। প্রথম স্ত্রী মারা যান। শুনেছি শ্বশুর, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ওপর মানসিক নির্যাতন করতেন। আমার স্ত্রীর আচার-আচরণ ভালো নয়। সাংসারিক কাজ অগোছালো। ফলে প্রায়ই আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে এবং খুব খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। সে ভীষণ জোরে কথা বলে, বোঝালে বুঝতে চায় না, যুক্তি ও বাস্তবতা মানে না। আমার কাছে মনে হয়েছে স্ত্রীর ছোটবেলায় শিক্ষা, শাসন ও আদব-কায়দার প্রচণ্ড অভাব ছিল। বর্তমানে তার কোনো কিছু আমার ভালো লাগে না, সবকিছু রুচিহীন মনে হয়। দুশ্চিন্তায় আমার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।
মারুফ
ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তুমি লিখেছো, বিয়ের এক বছর পর থেকেই তোমাদের মধ্যে অশান্তি চলছে। তাহলে তোমরা দুটো সন্তান এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে কেন, বল তো? তোমার ছেলের বয়স যদি পাঁচ হয়, তাহলে তো বলা যেতে পারে, একটি ভালোবাসাহীন সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ওর জন্ম হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এরপর কিন্তু তোমরা আরও একটি সন্তান নিয়ে এসেছো অশান্ত ও অস্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশে। আমাদের কারোরই কিন্তু কোনো অধিকার নেই নিষ্পাপ শিশুদের পৃথিবীতে এনে এভাবে কষ্ট দেওয়ার। তোমাদের দুজনের মধ্যে যদি যথেষ্ট সম্মানবোধ ও ভালোবাসা না থাকে, তাহলে কি আমি ধরে নেব, কেবল জৈবিক তাগিদেই তোমরা একসঙ্গে রয়েছো এবং একটির পর একটি সন্তান পৃথিবীতে এনেছো? সে ক্ষেত্রে তো মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণিকুলের পার্থক্য করা যাবে না, তাই না? সৃষ্টিকর্তা মানুষকে প্রচুর ক্ষমতা ও মেধা দিয়েছেন এবং আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই মেধা কাজে লাগিয়ে জীবনের বাধাগুলোর সঙ্গে সংগ্রাম করে একটি অর্থপূর্ণ ও সুস্থ জীবনযাপন করা। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া। একমাত্র নিজেকে সুস্থ রাখা সম্ভব হলেই আমরা পারিপার্শ্বিক বা পারিবারিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার শক্তি খুঁজে পাই। এ ছাড়া প্রত্যেকটি মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, বিয়ের পর প্রথমে একটি সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। যদি দেখা যায়, দাম্পত্য কলহের কারণে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে, তাহলে সেই পরিবেশে সন্তানদের নিয়ে আসা খুব অন্যায়। আমাদের দেশে অনেকের ধারণা, সন্তান এলে দাম্পত্য সুখ আপনা থেকেই তৈরি হবে। কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত ভুল ধারণা। কলহমুুখর পরিবারের শিশুরা কখনোই একজন মানসিকভাবে সুস্থ ও আত্মবিশ্বাসী নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে না। যদি তোমার মনে হয়, স্ত্রীর শৈশব নির্যাতন ও গালাগালির ভেতরে কেটেছে বলে তার আচরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তাহলে তো তোমার পরিবারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বিষণ্ন বাবা ও অগোছালো মায়ের সন্তানদের ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কথা, তাই না? যদি স্ত্রীকে মেনে নেওয়া কষ্টকর হয়, তাহলে তুমি নিজের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতেই পারো। কিন্তু তাতে করে সন্তানদের প্রতি তোমার দায়িত্ব কমে যাবে না। তোমরা স্বামী-স্ত্রী এই বিয়ের সম্পর্ক না থাকলেও সন্তানদের কথা ভেবে তোমাদের দুজনকেই ভবিষ্যতের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। আর যদি তোমরা সম্পর্ক রেখে চলতে চাও, তাহলে অবশ্যই কোনো কাউন্সেলর বা সাইকোথেরাপিস্টের সঙ্গে দেখা করে দুজনের দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি ইউনিটে সোমবার সকাল নয়টায় গেলে সাইকোথেরাপি কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নিতে পারবে। তুমি নিজের প্রতি যত্নশীল হতে চেষ্টা করো এবং সারাক্ষণ এই বিষয়গুলো না ভেবে কিছু সুস্থ বিনোদনচর্চায় মনোযোগী হও। স্ত্রী যেহেতু ছেলেবেলায় কষ্ট পেয়েছেন, তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখাতে না পারলেও অন্তত স্নেহপ্রবণ হতে পারো কি না, দেখো। তোমার আদর-স্নেহ হয়তো বা তার মধ্যে কোমল অনুভূতি তৈরি করতেও পারে। স্ত্রীকে বলবে, তোমাদের সবারই কোনো কাউন্সেলর বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর কাছে যেতে হবে সুস্থভাবে জীবনে চলার জন্য। তা না হলে সন্তানদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আশা রাখছি, সুন্দরভাবে ধৈর্য রক্ষা করে বললে সে তোমাকে সহযোগিতা করবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৩, ২০১০
Leave a Reply