জীবনে চলতে-ফিরতে যেসব আইনি জটিলতায় পড়তে হয়, পাঠকের উকিল বিভাগে ১৫ দিন পরপর তারই সমাধান পাওয়া যাবে।পাঠকের উকিল বিভাগে আইনি সমস্যার সমাধান দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট নাহিদ মাহতাব। স্পষ্ট করে নিজের সমস্যাটি লিখে পাঠান। প্রয়োজনীয় কাগজের অনুলিপি দিন। খামের ওপর লিখুন: পাঠকের উকিল, নকশা, দৈনিক প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুলইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।
একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৬ সালে। সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। ২০০৮ সালে আমরা ইসলামি শরিয়ত মতে কাবিন করে বিয়ে করি। আমিও চাকরির কারণে চট্টগ্রাম শহরে বাসা নিয়ে থাকতাম। তাই বিয়ের পর আমরা দুজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে প্রায়ই একসঙ্গে ছিলাম। বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবার ও বন্ধু মহল জানলেও মেয়েটি তার পরিবারকে কিছুই জানায়নি। আমি বরাবরই বিয়ের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিবারকে জানাতে চাইলে সে বলত, আর কিছুদিন পর। এভাবে দেখতে দেখতে ২০১০ সালের শুরুতে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। বিষয়টি তার মা জানতে পারেন। এরপর আমিও তার পরিবারের কাছে আমাদের সম্পর্ক ও বিয়ের বিষয়টি জানাই। মেয়েটি পরিবারের চাপে আমার সঙ্গে যোগাযাগ একটু কমিয়ে দেয়। পরে আমি জানতে পারি, তার গর্ভপাত করানো হয়েছে।কয়েক দিন পর ওরা বাসা পরিবর্তন করে ফেলে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তার পরিবার তাকে এক প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়। এ অবস্থায় আমি আইনানুগ কী ব্যবস্থা নিতে পারি? মেয়েটির দ্বিতীয় বিয়ে কি শরিয়ত ও আইনগতভাবে বৈধ হয়েছে? উল্লেখ্য, আমাদের একসঙ্গে বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। তার পাসপোর্টে স্বামী হিসেবে আমার নাম আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
বিবাহিত থাকাকালে আপনার স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ আইনের দৃষ্টিতে কোনো বিবাহ নয়। এ ধরনের বিবাহ আইনগতভাবে অবৈধ এবং তাতে কারও ওপর কোনো দায়দায়িত্ব বর্তায় না। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় এবং তালাকপ্রাপ্ত না হয়ে অন্য লোকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে ওই বিয়ে বাতিল বা ভয়েড হিসেবে গণ্য হয়। আপনি মুসলিম পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা করতে পারেন।
আমার বাবা একজন বাসচালক ছিলেন। আমার মায়ের সঙ্গে খুব সুন্দর সংসার চলছিল, কিন্তু এক বাস দুর্ঘটনায় আমার বাবার মস্তিষ্কে সমস্যা হয়। এরপর আমার মা আমাকে নিয়ে আমার নানার বাড়িতে চলে আসেন। তখন আমার বয়স ছয় মাস। আমার বাবা আমাকে ও আমার মাকে চিনতেন। কিন্তু কিছু সময় পর আবার আমাকে চিনতেন না। আমার কথা মনে পড়লে আমার নানা বাড়িতে আসতেন, আমাকে আদর করতেন। আমি যখন বুঝতে শিখি, তখন দেখি যে আমার বাবা আমার জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসেন। এবং কিছুদিন পর আমার বাবা মারা যান। আমি এখন বড় হয়েছি, এসএসসি পাস করেছি। আমি আমার মাকে নিয়ে আমার দাদার বাড়ি যেতে চাই। কিন্তু পারি না। কারণ আমার মা আমাকে নিয়ে চলে এসেছেন আর আমার বাবা মারা গেছেন। ওখানে আমার কিছু নেই—বলেন আমার চাচারা। আমার মা দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করেননি। আমাকে নিয়ে বেঁচে আছেন। দুই বছর হলো আমার বড় চাচা মারা গেছেন। তাঁর ছেলেমেয়ে ও বউ আছেন। ছোট চাচা বেঁচে আছেন, তাঁর সংসারও আছে। আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। এখন আমার দাদার সম্পত্তি পাব কি না? আমার দাদা-দাদি মারা গেছেন।
মো. রাসেল
মানিকগঞ্জ।
চিঠির তথ্য অনুযায়ী আপনার মা আপনার বাবার মৃত্যু পর্যন্ত আপনার বাবার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। সুতরাং বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তিতে আপনি ও আপনার মা অংশীদার। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী আপনার বাবা জীবিত থাকলে আপনার দাদার যে অংশ পেতেন, বাবার অবর্তমানে আপনার দাদার মৃত্যুর পর আপনারা সেই অংশ পাবেন। ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বের বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং দাদার সম্পত্তিতে অন্য চাচাদের মতো আপনিও হকদার।
আমার খালার চার মেয়ে। সবাই ছাত্রী। খালু সরকারি চাকরি করেন। প্রায় দুই বছর হয় খালা গৃহকর্মীর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন। খালু তাঁর সংসারের কথা চিন্তা করে খালাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তিনি বাধ্য হয়ে ওই ছেলেকে আদালতের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কিছুদিন পর খালা আবার ওই ছেলের কাছে চলে যান। আর স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি কখনোই খালুর সঙ্গে সংসার করবেন না। এখন খালু ও তাঁর পরিবারের কেউই খালাকে আনতে চান না। আইনগতভাবে খালা কি এখনো খালুর স্ত্রী আছেন? খালুর মৃত্যুর পর তিনি কি সম্পত্তির অংশীদার হবেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক , সিরাজগঞ্জ।
প্রথম স্বামীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বিয়ে করা শুধু অবৈধই নয়, তা দণ্ডবিধি অনুযায়ী একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেহেতু প্রথম বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় আপনার খালা অন্য ছেলেকে বিয়ে করেছেন, তাই আইন অনুযায়ী এ বিয়ে বৈধ নয়। বিয়ে বৈধ না হলেও কোনো আইনানুগ দায়দায়িত্বের সৃষ্টি হয় না। আপনার চিঠি অনুযায়ী আপনার খালার প্রথম বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি এবং ওই বিয়ে বলবৎ আছে। সে ক্ষেত্রে খালুর মৃত্যুর পর বৈধ স্ত্রী হিসেবে আপনার খালা তাঁর সম্পত্তির ওয়ারিশ হবেন। আপনার খালু তালাকের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন।
আমার বিয়ে হয়েছে সাত বছর হলো। একটি সন্তান আছে। বয়স পাঁচ বছর। দুই মাস হলো আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। এখন আমার স্বামীর কথাবার্তা, চালচলন আগের মতো নেই। তাকে আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু সে স্বীকার করেনি। আমাদের গ্রামে এলাকাবাসীর মুখে মুখে রটে গেছে তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা। আমার স্বামী অস্বীকার করলেও বিষয়টি সত্য। বিশ্বস্ত সূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়ি খুঁজে বের করা হয়েছে। সে বর্তমানে তার বাবার বাড়িতে থাকে। আমার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তার সঙ্গে সংসার করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। বিষয়টি আমি আমার বাবাকে জানিয়েছি। এক সপ্তাহ হলো আমি আমার বাবার বাড়িতে এসেছি। এখন আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই। তাকে এর পরিণাম বুঝিয়ে দিতে চাই। মামলা করব, তা করতে পারছি না। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তার দ্বিতীয় বিয়ের কাবিননামা না পেলে কীভাবে মামলা করব? এখন আমি কীভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারি?
নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯৬১-এর ৬ ধারা অনুযায়ী দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের আরবিট্রেশন কাউন্সিলের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে বিনা অনুমতিতে বিয়ের বিরুদ্ধে মামলা করলে সেই ব্যক্তির এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কারাদণ্ড ও জরিমানা উভয়ই হতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিয়ে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে বিয়ের কাবিননামা দেখাতে হবে। বিয়ের বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে প্রমাণ করা দুরূহ ব্যাপার। আপনি ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে আপনার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের তথ্যের জন্য আবেদন করতে পারেন।
আমি স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। আমার বাড়িতে সব সময় ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। আমার বাবা আমার প্রতি রেগে গেলেই বকাঝকা ও মারধর করেন এবং সব খরচ বন্ধ করে দেন। বাবা একজন সামর্থ্যবান ব্যক্তি। আমি কি আইনত তার কাছ থেকে আমার প্রয়োজনীয় খরচ পাওয়ার অধিকারী? আমি কীভাবে তাঁর কাছ থেকে আমার খরচ আদায় করতে পারব?
নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
আপনি মুসলিম পারিবারিক আদালতে নির্দিষ্ট কোর্ট ফি দিয়ে আপনার বাবার বিরুদ্ধে ভরণ-পোষণ আদায়ের মামলা করতে পারেন। ভরণ-পোষণের পরিমাণ আইনে নির্ধারিত নেই। সাধারণত আপনার জীবনযাপনের মান ও আপনার বাবার আর্থিক অবস্থানের ওপর ভরণ-পোষেণের অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৯, ২০১০
Leave a Reply