ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: আমার বয়স ২৪ বছর। উচ্চতা চার ফুট নয় ইঞ্চি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। উচ্চতা-সমস্যার কারণে কোনো মেয়ে আমাকে পছন্দ করে না, যার কারণে আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমার জীবনে আসেনি। সব সময় ভাবি, যদি কোনো দিন কোনো মেয়ে নিজের মুখে আমাকে ভালোবাসার কথা বলে, তবে তাকেই আমি জীবনসঙ্গী করব। তাই হঠাৎ ফোনে একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় এবং দুজন দুজনকে গভীর ভালোবাসা। কিন্তু হঠাৎ ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম, ও বিবাহিত ও কুৎসিত—যার কারণে প্রথম স্বামীর অত্যাচারের জন্য বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দশম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে। এখন আমি আমার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব, নাকি কুৎসিত চেহারা ও সমাজের মানুষের হিংস্র কুদৃষ্টিকে ভয় পাব? তাই খুব মানসিক কষ্টে আছি।
শিমুল আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পরামর্শ: তুমি নিজেকে এবং বাইরের বাকি সবাইকে শুধু বাইরের চেহারা দিয়ে বিচার করছ। অধিকাংশ মানুষই শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের ওপর গুরুত্ব দেয়। আর সেই কারণেই যারা দেখতে সুন্দর, তারা সবার মনোযোগ পাচ্ছে। এ পৃথিবীতে আমরা বাহ্যিক যে রূপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, তার জন্য আমরা যেমন দায়ী নই, ঠিক তেমনি এর জন্য কোনো কৃতিত্ব নেওয়ারও কিছু নেই। তোমার উচ্চতা কিছুটা কম বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছ বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি যদি এ কারণে নিজেকে অশ্রদ্ধা করো বা কম গুরুত্ব দাও, তাহলে নিজের প্রতি খুব অবিচার করা হবে। উচ্চতা কম হওয়ার কারণে নিজের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে গেলে তুমি অন্যদের প্রতি, বিশেষ করে কিছুটা কম সুন্দর এমন মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারবে না। তুমিও কি চাইবে যে একটি মেয়ে তোমাকে শুধু বাইরের চেহারার কারণে ভালোবাসবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, তোমার এত দিনের শিক্ষা, মূল্যবোধ, রুচিবোধ, বিশ্বাস, আচরণ, অভ্যাস বা চর্চা—এগুলোর কোনো মূল্য নেই। আর অন্যদের ভেতরও তুমি এ বিষয়গুলোর ইতিবাচক দিকগুলো দেখার চেষ্টা করছ না। আমি আশা করব, তুমি এ মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের ভেতরটাকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করবে। তুমি লিখেছ, একটি মেয়ের সঙ্গে তোমার ‘গভীর ভালোবাসা’ হয়েছে। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পরস্পরকে ভালোভাবে না জেনে এ রকম গভীর সম্পর্ক কি আদৌ সম্ভব? মেয়েটি দেখতে কেমন, তার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান কী, ওই তথ্যগুলো কি তুমি সম্প্র্রতি পেয়েছ? তাহলে কি ধরে নেব, তোমরা শুধুই আবেগের বশবর্তী হয়ে সম্পর্ককে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছ? এ ছাড়া মুঠোফোনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সম্পর্কে অনেক ফাঁক থেকে যায় বলে তোমাদের বয়সের ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক গভীর হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আসলে কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তাকে ভালোভাবে জানার আগে দুজনের আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে, তা ভালোভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। সে সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি সীমারেখা না টানি, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আমার অনুরোধ, তুমি যে মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করবে, তাকে পুরোপুরি সম্ভব না হলেও মোটামুটিভাবে বোঝার এবং জানার চেষ্টা করবে।
সমস্যা: আমি কাউকে প্রিয়তম হিসেবে ভালোবাসতে পারি না। সব সময় মনে হয়, আমি কারও জন্য অপেক্ষা করছি। ভালো লাগা থাকলেও কখনো ভালোবাসা হয়নি আমার। সারা রাত জেগে থাকা, চোখের সামনে প্রিয়মুখ ভাসা—এসব কখনো হয়নি আমার। অনেকেই অনেক বেশি ভালোবাসা আমার জন্য পোষণ করে। আমার সে রকম কোনো অনুভূতি তাদের জন্য হয় না। ভালোবাসা আমার প্রয়োজন, কিন্তু আমার মনে কোনো স্বচ্ছতা খুঁজে পাই না। মাঝেমধ্যে একা সারা জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এ সমাজে এটাও সম্ভব নয়। আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না কেন?
রাত্রি
ময়মনসিংহ
পরামর্শ: মনে হচ্ছে তুমি বিষণ্নতায় ভুগছ। বেশি দিন কাউকে ভালো না লাগলে তো ভালোবাসার পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তোমার নিজেকে কতটা ভালো লাগে বা নিজের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আস্থা রয়েছে কি না, তা কি কখনো ভেবে দেখেছ? কারণ, কাউকে ভালোবাসতে হলে সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। তোমার শৈশব কীভাবে কেটেছে, তা জানতে পারলে খুব ভালো হতো। কারণ, শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ধারণ করে দেয়। জন্মের পর থেকেই আশপাশে থাকা মানুষগুলো যদি অনেক আন্তরিকতা, স্নেহ, নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়ে একটি শিশুকে গ্রহণ করে নেয়, তাহলে তার মধ্যে অনেক বেশি বিশ্বাস বা আস্থা এবং নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়। বড় হওয়ার পর আমাদের সচেতনমনে না থাকলেও অবচেতনমনে কিন্তু পীড়াদায়ক স্মৃতিগুলো জমা হয়ে থাকে। আর সে কারণেই আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না, কেন মাঝেমধ্যে বিষণ্নতা ও একাকিত্ব আমাদের ঘিরে রাখে। তুমি ভেতরে খুব একা বলেই কি এত কষ্ট পাচ্ছ? তোমার যেহেতু ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, চেষ্টা করো নিজেকে শুধু জীবনের অর্জনগুলোর ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে তোমার ভেতরের
মানুষটিকে সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নিতে। তুমি কী কী করতে চাও, তার একটি তালিকা তৈরি করো। তারপর যেটি তুমি সবচেয়ে আগে করতে চাও, সেটি করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটির একটি পরিকল্পনা করো। একসঙ্গে অনেক কিছু না ভেবে যদি ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করো, তাহলে কিছুটা হলেও লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। যদি দেখো, কোনো একটি লক্ষ্য অর্জনের একটি ধাপে সফল হয়েছ, নিজেকে অভিনন্দন জানাবে এবং প্রচুর উৎসাহ দেবে। এভাবেই আমাদের ইতিবাচক আচরণগুলো ধরে রাখা সম্ভব।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৫, ২০১০
Leave a Reply