প্রতি বছরের মতো এবারও জুন মাসের তৃতীয় রবিবার অর্থাৎ আগামী ২০ জুন পালিত হবে বাবা দিবস হিসেবে। আর এই দিবসটিকে সামনে রেখেই বাবার প্রতি আমাদের নানা ভাবনা আর করণীয় নিয়ে লিখেছেন রাশেদুল হাসান শুভ
সেদিন একটা তথ্য পড়ে রীতিমতো চমকে উঠলাম। গেল এক দশকে মার্কিন মুলুকে একা হয়ে যাওয়া কিংবা ওল্ড হোমে আবাস গড়া বাবাদের ভিড় বেড়েছে। একই হাল ইউরোপের দেশগুলোতেও। সে হয় হোক। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অন্তত এটুকু ভেবে শান্তি পেলাম যে বাবার অতটা অমর্যাদা আমরা এখনও করিনি! আমাদের বাবা এখনও আমাদের মাঝেই থাকেন। আমাদের বাবা থাকেন আমাদের পাশে ছায়া হয়ে। অন্ধকারে বাবার অভিজ্ঞতা এখনও পথ দেখায় আমাদের কাউকে কাউকে। কিন্তু যে বাবা তার জীবন আর জীবিকার অনেকটা দিয়ে নিপুণ হাতে রচনা করতে চান তার সন্তানের ভবিষ্যৎ, সেই বাবার প্রতি জীবনসায়াহ্নে আমাদের শ্রদ্ধার পরিমাণটুকু কি একই রকম উঁচুদরে বাঁধা থাকে! আর যদি তা নাই হয় তাহলে সেই দায়টাই বা সন্তান হিসেবে কেন বয়ে বেড়াবে বাবার অপত্য স্নেহের অংশীদারেরা?
এক বয়সে বাবার প্রতি আমাদের কিংবা আমাদের প্রতি বাবার ভালোবাসার কমতি আমরা কখনই সেভাবে অনুভব করিনি। মা যখন তার স্নেহের আঁচলে রেখে আমাদের শিখিয়ে দেন আবেগ ও অনুভূতির একেকটা অধ্যায় তখন বাবা আমাদের হাঁটতে শেখান বাস্তব পৃথিবীতে। আমরা বাবার হাত ধরে পৃথিবীকে চিনি। আর একটু একটু করে বুঝতে শিখি বেঁচে থাকার মানেটুকু। এরই মাঝে হয়তো কখনো কখনো বাস্তবের জটিলতাগুলো বাবার আদেশের সুর হয়ে আমাদের কাছে বড্ড কঠোর আর কঠিন বলে মনে হয়। পথ দেখানো এক নাবিক হয়ে থাকা বাবাকে তখন মনে হয় জীবনসমুদ্রের ঝঞ্ঝায় ফেলে দেয়া এক অদ্ভুত মানুষ। কিন্তু যে মানুষটি জীবনযুদ্ধের জন্য তার সন্তানকে তৈরি করে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করে যান, তার কঠিনের পেছনের কোমল রূপটি যেন প্রায়ই আমাদের অচেনা থেকে যায়। এ কারণে বাবার শ্রমে-ঘামে আমরা বড় হতে থাকি। আর সেই সাথে বড় হতে থাকে আমাদের অহংবোধও। বাবার প্রতি আমাদের অভিমান হয়। আমাদের স্বাধীনতার পথেও বাবাকেই যেন মনে হয় সবচেয়ে বড় বাধা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভিতে দাঁড়ানো সন্তানের ব্যস্ততার প্রাবল্যে বাবা যেন সবার মাঝে থেকেও কেমন শূন্য হয়ে যান। হাসি-আনন্দের হুল্লোড়ে বাবা হয়ে যান মূল ভূখণ্ডের দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো। কিন্তু অতটা অবহেলা কিংবা অভিমান কি সত্যি পাওনা ছিল বাবার? কিংবা সন্তানের চোখে তার ভুলগুলোও কি ভুল ভাবনার জন্ম দেয়ার মতো গুরুতর কিছু ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর ভাববার সময়টাও যেন হয়ে ওঠে না আমাদের অনেকের। অন্যদিকে বাবার ছায়ায় থেকে সেই শুরু থেকে আজ অবধি যারা চলতে শিখেছে পৃথিবীর পথে, তাদের জন্য বাবা কিন্তু কখনই অতটা বোঝা হয়ে ওঠেন না। বরং বন্ধুর মতো বন্ধুর পথে বাবাই তার মুগ্ধপ্রাণ সন্তানদের বাঁচতে শেখান, শেখান ভালোবাসতে।
আমাদের সমাজে আর যাপিত জীবনে বাবার ভূমিকাটাকে হয়তো কখনই অত বড় করে দেখার সুযোগ হয় না আমাদের। আর তাই বাবার ক্লান্তি, শ্রম আর ভালোবাসাটাকে যেন কখনো কখনো ‘বাবার দায়িত্ব’ বলেই উপেক্ষা করতে চাই আমরা। কিন্তু জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত হয়ে পড়া আমাদের বাবা যে সময়টায় সামান্য একটু নির্ভরতা খোঁজেন আমাদের মাঝে তখন তাকে উপেক্ষা করা কি সন্তানের সাজে? যে বাবা সন্তানের মঙ্গল কামনা ছাড়া অন্য কিছু কখনো প্রত্যাশা করেন না সেই বাবাকে নিজেদের ব্যক্তিজীবনে ‘বাড়তি কৈফিয়তের’ স্থান হিসেবে ভাবাটাও কি যৌক্তিক হয়? হয়তো হয় না। তবু একা একা ছুটে চলা এই সময়ের মাঝে এই অমার্জনীয় ভুলকেই যেন আমরা অনায়াসে স্থান করে দেই আমাদের মাঝে। ভুলে যাই বাবার অপত্য স্নেহের মাঝে বেড়ে ওঠা আমাদের শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোকেও।
বাবার সাথে সন্তানের যে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তাতে দু’দলেরই কিছু না কিছু করার আছে। বাবা হয়তো সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়েই ফিরলেন বাড়িতে। সে ক্ষেত্রে তার জন্য ভালোবাসার বারতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে সন্তানকেই। আবার সন্তান যখন মনের মাঝে ঘর-বসতি গড়ে দিনে দিনে নিভৃতচারী হয়ে উঠছে তখন তার ভাবনাগুলো ভাগ করে নিতে সামনে এগুতে হবে বাবাকে। কেননা সন্তান যত বড়ই হোক, তার অভিমান আর অবহেলার গুণিতক যতই বিশাল হোক বাবার স্নেহ সবসময়ই তার জন্য এক পরম আশ্রয়। তাই সন্তান হিসেবে আপনাকেও ভাবতে হবে বাবার কথা। তার আবেগ-অনুভূতি আর পরিণত বয়সের চাওয়া-পাওয়াগুলোর দিকে রাখতে হবে বাড়তি দৃষ্টি। যে বয়সে স্কুল-কলেজে নতুন নতুন বন্ধুর সাথে বেশ জমে উঠছে সে সময়টাতে ভুলে যাওয়া চলবে না পুরনো বন্ধুকে। বরং নিজের জীবনের এই খোলস ছাড়ার মুহূর্তে যদি বাবাকেও সাথী হিসেবে নেয়া যায় তাহলে বরং চেনা বন্ধুত্বগুলোও নতুন রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। আবার যারা পড়াশোনার পাট চুকিয়ে এখন দিব্যি দিন কাটাচ্ছেন আয়-উপার্জনে তাদেরকেও সময় করে ভাবতে হবে বাবার কথা। মনে রাখবেন আপনার-আমার, আমাদের বাবা কিন্তু আমাদের কাছে বড় কোনো উপহার চান না, বরং ব্যস্ততার মাঝে বের করে নেয়া একটু সময় বাবাকে দিয়েই দেখুন না কেন। হলফ করে বলতে পারি, এমন কোনো বাবা নেই যিনি সন্তানের এই সান্নিধ্যটুকু উপভোগ করেন না। অন্যদিকে জীবনের অমোঘ নিয়মে যারা বহুদিন আগেই হারিয়েছেন তাদের বাবাকে তারাও কিন্তু বাবাকে ভালোবেসে করতে পারেন অনেক কিছু। এটা হতে পারে বাবার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা কিংবা বাবার অপূর্ণ ইচ্ছে আর বাবার আদর্শের বাস্তবায়ন। সারা জীবনের সাধনায় বাবা আপনাকে যেখানে দেখতে চেয়েছিলেন বাবার মৃত্যুর পর সে জায়গাটিতে যদি নিজেকে পৌঁছে দিতে পারেন তবে সেটা ভালোবাসার যোগ্য প্রতিদানই হবে বৈকি।
বাবা দিবসকে সামনে রেখে বাবার আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে হয়তো অনেক কথাই বলা হলো, কিন্তু এত কিছুর পরও এরকম দু-একটা দিবসের কি সাধ্য বাবার বিশালতাকে ধারণ করার। বরং বাবা তার আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকবেন তার কৃতজ্ঞচিত্ত সন্তানের মাঝে। অনেকটা যেমন করে আমরাও বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি আমাদের উত্তর প্রজন্মের মাঝে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ১৫, ২০১০
Leave a Reply