চুল। আর কিছু নয়, সামান্য চুল নিয়ে এতো কথা। ব্যাপারটিকে আপনি যত সামান্য ভাবছেন, ততটা সামান্য হয়তো নয়। চকচকে টাক মাথা যার, কিংবা সুন্দর চুল নয় বলে যাকে এলোকেশী কিংবা দীর্ঘকেশী বলা হলো না, তার কাছে চুলের গুরুত্ব অন্যরকম। খানিকটা চুলচেরা বিশ্লেষণের মতোই চুলের গুরুত্ব চুলের মতোই সূক্ষ্ম। তাই নিয়ে লিখেছেন সামিয়া আসাদী
শুধু সৌন্দর্য বিদ্যায় নয়, রূপ-সৌন্দর্যের দুয়ার বাদেও চুলের জোয়ার কিন্তু শরীর বিদ্যাতেও কার্যকরী। অ্যানাটমি বিদ্যায় আমাদের চুলের ভূমিকা কি তার পরিপূর্ণ খোঁজ নিলে জানা যাবে, চুলের প্রধান ভূমিকা শক অ্যাবজর্বার-এর। আমাদের মাথার যে অংশে মগজ বা ঘিলু আছে, তাতে আছে গ্রে ম্যাটার নামক অত্যন্ত স্পর্শকাতর পদার্থ। এটি এতোটাই স্পর্শকাতর যে খুলি নামক শক্ত মোড়কেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তা যথাযথ নিরাপদ নয়। তাই নানা আঘাত থেকে মাথার মূল অংশকে রক্ষা করতেই চুলের সৃষ্টি। চুলকে চিকিৎসা বিজ্ঞান যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন, কবির ভাবনায় চুল যেন নারী সৌন্দর্যের আপন রূপকার। নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় তাই কবিকে খুব সহজেই চুলাশ্রয়ী হতে হয়। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’, ‘জড়িয়ে পড়েছি তোমার ছড়ানো চুলে খাঁ খাঁ দুপুরের তৃষ্ণাজনিত ভুলে’, ‘পিছন থেকে দেখিনু কোমল গ্রীবা লোভন হয়েছে রেশম চিকন চুলে’, ‘তোমার চুলের ঝড় যেন আমাদের ঘোড়সওয়ার’ ‘কালো মেঘের চুলে খেলেছি ডানা’ণ্ডজীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা শামসুর রাহমান কেউই নারী সৌন্দর্যের মহাস্ত্র চুলকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। পারে না আধুনিক কালের যুবকরাও। তাইতো রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো পাড়াতো ভাইরা সুন্দর কেশের অধিকারিণী দেখলে ডেকে ওঠে ‘ও কেশবতী কন্যা’।
শুধু সাহিত্য কিংবা কবিতায় নয় বাস্তব জীবনেও একথা সরল সত্য যে চুল নারীর সৌন্দর্যের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান, নিদেনপক্ষে অনেক অসুন্দরকে নিমেষে আড়াল করার শ্রেষ্ঠতম উপায়তো বটেই। আজকাল সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় চুল তাই অনেক বিচার্য বিষয়ের একটি। অনেকেই বলেন ইদানীং চুলের কদর অনেক কমে গেছে। অথচ এককালে চুল দেখে বিয়ে হতো। তবে দৈর্ঘ্যের ব্যাপ্তি কমে আসলেও চুল নিয়ে নারীর নানা সৌন্দর্যপ্রিয়তা কিন্তু কমে যায়নি।
আজকের দিনে চুল শুধু মাথা ঢেকে রাখার উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয় না। বরং চুল এখন বিবেচিত হয় ত্বকেরই একটি অংশ হিসেবে। তীব্র গরমে চুল যেমনি রোদের আঁচ থেকে পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করে, তেমনি ঠান্ডা আবহাওয়ায় শরীরের ভেতরের তাপকে আটকে রাখে।
চুলের পিতৃপুরুষ কে? এ প্রশ্নের সহজসরল জবাব ত্বক। কেননা, চুল আমাদের দেহ ত্বকেরই অংশবিশেষ। মায়ের গর্ভে ভ্রুণের বয়স যখন মাত্র তিন সপ্তাহ তখনই চুলের আদি জন্মকাল। চুলের মূল বা গোড়া থাকে ত্বকের নিচের কেশ কূপে, যাকে বলা হয় ‘হেয়ার ফলিকল’। আর চুলের কাণ্ড বা শ্যাফটস থাকে বাইরে। এই অংশটাকেই আমরা বাইরে থেকে দেখি।
চুলের বাইরের আবরণের নাম কিউটিকল, একটুখানি ভেতরে থাকে কর্টেক্স এবং একদম ভেতরে মেডুলা। মাথার চুলের ক্ষেত্রে মেডুলা থাকে না। কর্টেক্সে থাকে রঞ্জক পদার্থ মেলানিন, যার পরিমাণের ওপর চুল কতোটা কালো হবে তা নির্ভর করে। চুলের গোড়া বা হেয়ার ফলিকলের নিচে থাকে কিছু সজীব কোষ বা হেয়ার ম্যাট্রিক্স। এই ম্যাট্রিক্সকে নিয়ন্ত্রণ করে বংশগতি ও নানা ধরনের হরমোন। চুলের পুষ্টি আসে ত্বকের নানা পুষ্টি থেকে। চুলের অধিকাংশ কোষই মৃত, কেবলমাত্র চুলের গোড়ায় কিছু কিছু জীবিত স্নায়ুকোষ থাকে। চুলের গঠনের মধ্যে কেরাটিন নামের এক ধরনের তন্তু বা ফাইবার জাতীয় প্রোটিন থাকে। প্রতিটি চুলের গায়েই কেরাটিনের আস্তরণ থাকে। চুলের এই বাইরের স্তরটিকেই বলে কিউটিকল। এই কিউটিকল স্তরের ভেতরে পাইপের মতো একটি মূল স্তর থাকে, তাই চুলের শক্তি যাকে আমরা আগেই কর্টেক্স নামে আখ্যা দিয়েছি। কিউটিকল অংশটি ছোট ছোট স্বচ্ছ স্কেল দিয়ে তৈরি। এই স্কেলগুলো একটি আরেকটির ওপরে চাপানো থাকে মাছের আঁশের মতো। কিউটিকল অংশের রঙ বদলায় না। চুল যখন পাকে তখন মূলতঃ কর্টেক্স অংশেরই রঙ বদলায়। আর চুলের যত্ন মানেই এই দু’টি অংশের যত্ন। চুল নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণ কিছুদিন আগেও অনেকের জানা ছিল না। বিজ্ঞানের আধুনিক চর্চাতেই এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার এসব তথ্য উদ্ঘাটনের সবচেয়ে বড় সূত্র। এর পূর্ব পর্যন্ত সৌন্দর্যবিদ কিংবা রাজবৈদ্যরা চুলের পরিচর্যার যাবতীয় পরামর্শ দিতেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষন শক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের আলোকে। এক্ষেত্রে সামগ্রিক শরীর বিজ্ঞানের জ্ঞানই প্রাধান্য পেত।
প্রাচীনকাল থেকেই চুল নিয়ে মানুষের চিন্তার শেষ নেই। তখন থেকেই এ সত্যটি সব মানুষই জানতো যে, মানুষের শরীরে চুল হলো অন্যতম রূপচিহ্ন। চুল নিয়মিত কাটা কিংবা ন্যাড়া হওয়াটাই ছিলো সর্বোতকৃষ্ট যত্ন। অবশ্য অন্যান্য সভ্যতার মেয়েরা তখনও চুল কাটতো না। বড় চুল ছিল বড় সৌন্দর্যের অংশ। কোনো কোনো সভ্যতায় চুলে স্বর্ণরেণু দেবার প্রচলন ছিল। কেউ কেউ হলুদ সুগন্ধি পাউডার ছড়িয়ে দিত চুলে। আবার বিশেষ সামাজিক উৎসবে হালকা মাড় দিয়ে চুলটা শক্ত কড়কড়ে করে তুলতেন কেউ কেউ। সেই শক্তচুলে নানা রকম অলংকারও পড়া হতো। এভাবেই চুল নিয়ে চলতো নানা যত্ন আত্তি ও গবেষণা।
চুলের যত্নে প্রাচীন ঐতিহ্যের নাম হেনা। কবে, কোথায়, কী করে এই চির সবুজ ছোট গুল্মটির পাতার প্রলেপ মানুষ চুলে ব্যবহার করতে শিখল তা আজো অজানা। এরই সূত্র ধরে কবে থেকে মেহেদির ব্যবহার তাও অনেক ক্ষেত্রেই জানা যায়নি। শুধু ভেষজ বলেই নয়, প্রায় নিত্য ব্যবহার্য কসমেটিকস হিসেবেও মেহেদি পরিচিত ছিল। খুব সম্ভবত প্রাচীন গ্রীসে মেহেদির সঙ্গে নানারকম রঙ মেশানো হত। মেহেদি ব্যবহারে চুল কাঁচা করে বয়সকে ঢাকার চেষ্টা তখনও প্রচলন ছিল। মুসলিম সভ্যতাতেও চুলের যত্নে নানা কাণ্ড হতো। বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা দুনিয়া সেরা সুগন্ধী সংগ্রহ করতো। শৈলীর এহ্তর, সমরখন্দের খসস্, হিন্দুস্তানের কস্তুরী মৃগনাভি, রোমের সবচেয়ে দামী গন্ধদ্রব্য ঢেলে ভর্তি করা হতো গোসল ঘরের চৌবাচ্চা। মরুসুন্দরী তাতারকন্যা দিনশেষে সেই পানিতে সোনার অঙ্গ ভিজিয়ে কেলি করতেন। তখন বাঁদীর দল হেনা দিয়ে মাথা ধুয়ে সামান্য রজনের আঁঠার ধোঁয়া লাগিয়ে সোনার কাঁকই দিয়ে চুল আঁচড়ে দিত।
তখন উপমহাদেশীয় সভ্যতায় চুলের যত্নে ব্যবহৃত হতো আরেকটি মজার উপাদান ‘নিমপাতা’। আর এখানকার সংস্কৃতিতে চুল ছিলো আভিজাত্য, সামাজিক অবস্থান ও শৌখিনতার প্রতীক। যাবতীয় ভারতীয় চিত্রে কিংবা ভাষ্কর্যে ফুটে ওঠে সেই রূপ। গ্রীক সংস্কৃতির পরশে প্রভাবিত গান্ধার শিল্পরীতির বুদ্ধমূর্তির মাথায় শিল্পী খোদাই করে তুললেন একমাথা কোঁকড়ানো চুল একটি সুগোল করবী। সেই সময়ে চীনে মাঞ্জু রাজবংশের প্রভাবশালী রাজকন্যরা ও রাজপুরুষেরা তেল দিয়ে সুন্দর করে চুল আঁচড়ে একটি সূক্ষ্ম কাজ করা রুমালে মাথা ঢেকে রাখতেন, যাতে চুলের অযত্ন না হয়। সেই রুমাল ধরে পেছন থেকে টানা ছিল ক্ষমার অযোগ্য অসভ্যতা ও অপমান।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জুন ০১, ২০১০
Leave a Reply