ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: সেদিন সকালে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। পথে একদল বখাটে ছেলে আমার গতি রোধ করে এবং অস্ত্র উঁচিয়ে আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে। আমি দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। সন্ত্রাসীরা সবাই আমার পরিচিত। আমার বাসায় বিষয়টি জানাই। কিন্তু ওরা সন্ত্রাসী বলে বাসা থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি। সন্ত্রাসীদের মধ্যে একজন খুবই ভয়ংকর, যাকে দেখামাত্র আমি খুবই ভয় পাই; এমনকি অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়। সে আমাকে মাঝেমধ্যে ফোনে ভয় দেখায় এবং হুমকি দিয়ে কথা বলে। একবার তার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করতে চেয়েছিলাম। এতে আমার এক বন্ধু নিষেধ করলে বিরত থাকি। আমি খুব শংকিত।
বি.দ্র.: আমার হার্টের সমস্যা আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
গাজীপুর।
পরামর্শ: ঘটনাটি বেশ অনেক দিন আগে ঘটেছে কিন্তু তুমি এখনো ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারোনি। তবে সন্ত্রাসীরা কী কারণে তোমার গতি রোধ করে আঘাত করতে চেয়েছিল, তা উল্লেখ করোনি। তোমার চিঠিতে এটাও পরিষ্কার নয়, তারা কেন তোমাকে এত দিন ধরে ভয় দেখিয়েই যাচ্ছে। তারা আসলে কী চাইছে বলে তোমার মনে হয়? এমন কি হতে পারে যে তুমি তাদের দেখলে বা গলার স্বর শুনলে খুব বেশি ভয় পেয়ে যাচ্ছ বলে তারা এ ধরনের মজা পাচ্ছে? দেখা যায়, যারা রাস্তায় হাইজ্যাক করে, তারা কিন্তু একই ব্যক্তির ওপর একাধিকবার আক্রমণ করে। এর একটি কারণ হচ্ছে, অপরাধীরা রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের মুখের অভিব্যক্তি দেখলে আন্দাজ করতে পারে, কাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কম এবং কারা সব সময় ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। তোমাকে এখন প্রথমেই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ভীতির জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। নিজেকে বোঝাবে, অনেক দিন তো হয়ে গেল, সন্ত্রাসীরা হয়তো বা খুব বেশি ভয়ংকর নয়। নিজেকে এটাও বলবে, ভবিষ্যৎ আমরা তো কেউ জানি না, এখন থেকে ভবিষ্যতে কী হবে, তা ভেবে নিজের মানসিক ক্ষতি করাটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। সন্ত্রাসীদের মধ্যে যে মানুষটির কথা মনে হলে তোমার ভয় বেড়ে যায়, তার চেহারাটি মনের কোণে উঁকি দেওয়ার সময় নিজেকে বারবার বলবে, ভয় নেই, কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। এ কথাগুলো ভাবার সময় খুব বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে খুব আস্তে করে সেটা ছাড়বে। এভাবে নিজের ভেতরে সাহস তৈরি করে তুমি নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে পারো। তোমার আত্মবিশ্বাসী গলার স্বর শুনলে ও সাহসী পদক্ষেপে চলাফেরা দেখতে পেলে তারা হয়তো এ কাজটি করা থেকে বিরত থাকতে পারে। যাদের মধ্যে মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম থাকে, তারা এ ধরনের ঘটনার পর আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। যেহেতু বেশ দীর্ঘ সময় ধরে এসব উপসর্গ চলছে, তুমি কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে সাইকোথেরাপির সাহায্য নিতে পারো। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে এই থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে।
সমস্যা: প্রায় এক বছর ধরে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আমাকে অনেক জটিল সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এমনকি আমার জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না। তবুও তাকে জান দিয়ে ভালোবাসতাম। আমার পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছিল। বর্তমানে সে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। এত বড় প্রতারণা মেনে নিতে পারছি না। আমি অনেক দুর্বিষহ জীবন যাপন করছি। তাকে ভুলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। প্রায় সময় বাইরে কাটাই। পড়ার টেবিলে বসতেই পারি না। বুঝতে পারছি, এ সময় পড়াশোনা করে কাজে লাগাতে না পারলে জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে, তবুও হচ্ছে না।
রোহান
ঝিনাইদহ।
পরামর্শ: তোমার ফল খারাপ হওয়া, জীবনের অনিশ্চয়তা, নানা জটিলতা—এ বিষয়গুলোর জন্য কি তুমি মেয়েটিকে দায়ী করছো? এ ব্যাপারগুলো ঘটার জন্য কিন্তু তোমারই সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, নিজের ক্ষতি হয় তেমন কোনো সিন্ধান্তের দায়িত্ব কিন্তু যার ক্ষতি হচ্ছে, তারই আগে থেকে ভাবতে হবে। তবে এ জন্য নিজেকে অবশ্যই অপরাধী ভাবার কিছু নেই। আমরা এ ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি ভবিষ্যতে তা কাজে লাগাই, তাহলে এ ধরনের ঝামেলা জীবনে কম হয়। তা ছাড়া মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে তোমারও তো স্বার্থ জড়িত ছিল, তাই নয় কি? মেয়েটি যেহেতু অন্য একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, ধরে নেওয়া যেতে পারে, তোমাদের সম্পর্কের মধ্যে হয়তো আন্তরিকতা, সততা, পারস্পরিক অঙ্গীকার ছিল না। সম্পর্কের মধ্যে একটি ছোট ফাটল যখন ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করে, তখনই তৃতীয় ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে। তবে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, তোমার মধ্যে অন্তত এই সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সময়গুলো এখন কাজে লাগাতে না পারলে জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি এই উপলব্ধি ধরে রেখে যদি যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারো, অবশ্যই উপকৃত হবে। নিজেকে বলবে, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আসলে প্রেমের সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকলে ভালোভাবে লেখাপড়া চালাতে খুব অসুবিধা হয়। আর একটি সম্পর্ককে সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে হলে খুব ভালো যোগাযোগ দক্ষতা এবং আবেগের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয়। আশা করি, ভবিষ্যতে আবার এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তুমি অন্তত নিজের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৯, ২০১০
Leave a Reply