২০০৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়কার কথা। আবির হোসেনের বাবা কাজে এসেছেন ঢাকায়। ছেলের বাসায় ছিলেন তিন-চার দিন। নাতির সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক দাদার। তবে বাবা চলে যাওয়ার পর স্ত্রীর মুখে আবির শুনল, তার বাবা ব্রাজিলের একটা স্টিকার নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বছর পাঁচেকের নাতি আর সেটা দেয়নি দাদাকে। আবির স্ত্রীকে বলে, স্টিকার কোনো ব্যাপার নাকি! কালই এনে দেব অনেক স্টিকার। তোমার ছেলেকে দিও, তোমার শ্বশুরকেও পাঠাব। আবির ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার অনেক স্টিকার এনে রেখে দেয় অফিসে। ছেলের জন্য বাসায়ও নিয়ে যায় কিছু। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে থাকা নিজের বাবার কাছে আর স্টিকার পাঠানো হয় না। চলে যায় বিশ্বকাপ।
কয়েক মাস পর আবিরের বাবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। রাতেই ছুটে যায় বাড়িতে। পরদিন দুপুরের মধ্যে আবির বাবাকে ভর্তি করে ঢাকার বড় এক হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের দিনগুলোতে রাতে বাবার সঙ্গে থাকা হয়নি তার। মা নিজেই মানা করে দেন, ‘সারা দিন অফিস করে রাত জাগার দরকার নেই। শরীর খারাপ করবে।’
এরই মধ্যে আবিরের মনে পড়ে, বাবাকে ব্রাজিলের স্টিকার দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল থেকে মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন বাবা। তখন আবিরের একটাই চাওয়া—যেভাবেই হোক, ২০১০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাবা যেন বেঁচে থাকেন। তাঁকে স্টিকার দিতে হবে। শুরু হয়ে গেছে এবারের বিশ্বকাপ। এবার কি বাবাকে স্টিকার দেওয়া হবে?
হয়তো হবে, হয়তো হবে না। কেননা বাবারা তো কখনো কোনো অভিযোগ করেন না। মা-বাবার একমাত্র সন্তান আবির যখন ছোট, তখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শিক্ষা বোর্ডের খাতা নেওয়ার সভা থেকে শুরু করে যেকোনো অনুষ্ঠানেই বাবার হাত ধরে যেত সে। ঢাকায় বছর-দুবছরে একবার বেড়াতে এসে বাবার হাত ধরেই শহরটাকে চিনেছিল একদিন। এখন মুঠোফোনে সপ্তাহে তিন-চার দিন কথা বলা, মাসের শুরুতে টাকা বা ওষুধ পাঠানোর কাজটা সে করে ঠিকই, কিন্তু বাবার হাত ধরে তাঁকে তাঁর প্রিয় কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে না।
আমরা যখন বড় হয়ে উঠি, কারও বাবা বা মা হয়ে উঠি; তখন যতটা আমরা কর্তব্য পালন করি, ততটা কি বাবা বা মাকে বুঝি? বাবা যখন অসুস্থ হন, তখন তাঁর চিকিৎসার সুব্যবস্থা করি; কিন্তু তাঁর মনটাকে কি বোঝার চেষ্টা করি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা ‘না’। ‘স্নেহ নিম্নগামী’ এই আপ্তবাক্য ধরে নিজেদের সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ততা বেশি আমাদের। বাবার কাছে যেতে চার ঘণ্টার পথ পেরোতে আমাদের চার মাসই লেগে যায়। কিন্তু বাবা-মা যখন একা হয়ে যান, তখন তাঁদের ছোট ছোট শখ, ছোট ছোট ইচ্ছা তো পূরণ করাই যায়।
‘শেষ দিন পর্যন্ত আমার বাবা অফিসে কাজ করে গেছেন ঠিকই, কিন্তু অফিস থেকে ফেরার পর বাবার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। নানা বিষয়ে কথা বলেছি। আর্থিকভাবে না পারলেও মানসিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। বাবা ছিলেন আমার বন্ধুর মতো।’ কথাসাহিত্যিক ও সাপ্তাহিক ২০০০ সম্পাদক মইনুল আহসান সাবের এভাবেই বললেন তাঁর বাবা কবি আহসান হাবীব সম্পর্কে। যোগ করলেন, ‘বাবা আর সন্তানের সম্পর্কটা এমনই হওয়া উচিত।’
বাবা-সন্তানের সম্পর্কের ব্যাপারকে আরও বিস্তৃত করেন মইনুল আহসান সাবের। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ছোট, আশপাশে তখন অনেক বন্ধু থাকলেও বাবাই কিন্তু ছিলেন বড় বন্ধু। আমার পৃথিবীটা তৈরি হচ্ছে আর তা তৈরি করে দিচ্ছেন আমার বাবা।’ শৈশব থেকেই বাবা নামের বটবৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে ওঠে সন্তান। এরপর সেই সন্তান বড় হয়, বাবারও বয়স বাড়তে থাকে।
‘বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবার যেন শৈশবে ফিরে যেতে থাকে। তিনি তখন কিছুটা অবুঝ হয়ে যান। শিশুর মতোও আচরণ করতে থাকেন। সন্তানের বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে বাবা যে সমর্থন, যে সহায়তা দিয়েছিলেন, তখন তাঁকে সেই সহায়তা দিতে হবে। বিশেষ করে, মানসিক সহায়তা তো দিতেই হবে। বৃদ্ধ বয়সে মানসিক শক্তিটা কমে আসে, সেই শক্তি তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। বেড়াতে ভালো লাগলে তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে।’ বললেন মইনুল আহসান সাবের। অর্থাৎ, বাবা যেন কখনো নিজেকে একা না মনে করেন, নিজের ইচ্ছেগুলো অপূর্ণ থেকে গেল, এমন বোধ যেন তাঁর মধ্যে না জাগে—এসব খেয়াল করা সন্তানের মূল কাজ।
কলকাতার একটা ছবি লাঠি। প্রভাত রায়ের পরিচালনায় এ ছবিতে বাবা হচ্ছেন ভিক্টর ব্যানার্জি, বিপত্নীক, শিক্ষক। যেদিন তিনি অবসর নেন তাঁর বিদ্যালয় থেকে, সেদিন অনেক কিছুর সঙ্গে একটা লাঠিও উপহার দেওয়া হয় তাঁকে। বাড়িতে ফিরে উপহারগুলো দেখাতে থাকেন ছেলেদের। সবাই উপহারগুলো ভাগ করে নেয়। মেয়ে অবশ্য কিছুই নেয় না। সব উপহার ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়ার পর সদ্য অবসরে যাওয়া এই শিক্ষকের নিজের জন্য শুধু সেই লাঠিটাই থাকে।
জড় কোনো বস্তু নয়, সন্তানেরই তো বাবার লাঠি হয়ে ওঠার কথা। সেটাই হওয়া উচিত। ‘ছোটবেলায় বিশেষ করে, বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্বটা সবচেয়ে বেশি। ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হয় তাঁকে। সন্তান যখন বড় হয়ে যায়, মা-বাবা তখন একা হয়ে যান। এ সময়টায় বাবাকে মানসিক সহায়তা দিতে হয়।’ বললেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফিরোজা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘বাবা কী চান? সন্তানেরা কাছে থাকুক, ভালো থাকুক। কিন্তু সব সময় তা হয় না। সাধারণত বাবার প্রতি মেয়েদের টান বেশি থাকলেও বিয়ের পর অন্য সংসারে গিয়ে বাবাকে খুব বেশি সহায়তা সে করতে পারে না। ছেলেদেরও দেখা যায় নিজের সংসার নিয়েই যত ব্যস্ততা। আমি এমনও দেখেছি, সচ্ছল ঘরের বাবা-মায়েরও স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। এমনটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। বাবা বা মাকে নিজের কাছে এনে রাখা তো ছেলের জন্য কোনো ব্যাপারই না।’
কাছে থাকতে না পারলেও দূরে গেলেও বাবার খোঁজ নিতে হবে নিয়মিত। বলেন ফিরোজা সুলতানা। তিনি আরও যোগ করেন, ‘বাবাকে আর্থিক, সামাজিক, মানসিক সব সহায়তাই দিতে হবে। তিনি যে পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা সব সময় বোঝাতে হবে। অবসর নেওয়ার পরে তো বটেই, অবসরের আগেও ছেলেমেয়েদের উচিত বাবা-মাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। বেড়ানোর কোনো আয়োজন করলে তাতে তাঁদের যুক্ত করা উচিত। এতে পারিবারিক বন্ধনটাও অনেক দৃঢ় হয়।’
বাবা দিবসের মতো দিবস-সংস্কৃতি আমাদের এখানে নতুন। তবে জুন মাসের তৃতীয় রোববার (এবার ২০ জুন) বাবা দিবসে বাবার জন্য বিশেষ উপহার, বিশেষ জায়গায় খেতে যাওয়া বা বেড়াতে যাওয়া—এসব তো বাবাকে খুশি করবেই। এ দিনটা যেন শুধু বাবারই হয়ে ওঠে, তেমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
বাবার সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশা—ছোট থেকে বড়বেলা সব সময়ই বাবা সন্তানের বন্ধু এমন উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। আবার এমন উদাহরণও আছে, টানা দেড় দশক অসুস্থ, প্রায় চলৎশক্তিহীন বাবার সব ধরনের সেবা করেছে ছেলে। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছে প্রতিদিন। বাবাকে বোঝা, তাঁর প্রয়োজন বোঝা, তাঁর একাকিত্বে সঙ্গীর অভাব পূরণ করাই তো সন্তানদের প্রধান কাজ; যাতে বাবা বুঝতে পারেন, একদিন তিনি যার সহায় ছিলেন, আজ সে তাঁর সহায়।
পল্লব মোহাইমেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৫, ২০১০
Leave a Reply