ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন।—বি.স.
সমস্যা: স্কুল ও কলেজ-জীবনে ছেলেদের সঙ্গে সখ্য ছিলনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর মুঠোফোনের মাধ্যমে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছেলে এবং পরে তার বন্ধুর সঙ্গে আমার ভালো একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথম প্রথম তারা আমাকে খুব গুরুত্ব দিত। বর্তমানে তারা আমাকে এক কথায় পাত্তাই দেয় না। ওদের সঙ্গে মেশার পর বুঝেছি, ওরা নিত্যনতুন সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। তা ছাড়া ওদের আরও কিছু খারাপ অভ্যাস আছে, যা দেখে আমার খুব কাছের বান্ধবী আমাকে তাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করেছে। আমিও ওদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। আমি কেমন অবোধের মতো ওদের ফোনের অপেক্ষায় থাকি। একসময় নিজেই ফোন করি। আবার ওদের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়েকে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: ছেলে দুটিকে তুমি বন্ধু হিসেবে দেখেছিলে, নাকি প্রেমিক হিসেবে? যদি ওদের বন্ধু ভেবে থাকো, তাহলে তো এত অল্প সময়ে ভালো বন্ধু চেনা সম্ভব নয়, আর যদি প্রেমিক হয়, তাহলে তো একই সঙ্গে দুজনই প্রেমিক হতে পারে না, তাই না? তুমি লিখেছ, ওদের সঙ্গে অন্য কোনো মেয়েকে দেখলে কষ্ট পাচ্ছ। তাতে কি এটা হতে পারে যে তুমি ওদের দুজনের প্রতিই দুর্বল? আমার ধারণা, ছেলেদের সঙ্গে এই প্রথম বন্ধুত্ব হওয়ায় তুমি আসলে বেশ বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছ। শিশু বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা যদি পরস্পরকে বিপরীত লিঙ্গের একজন হিসেবে না দেখে, কজন মানুষ বা সহপাঠী হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে তোমার মতো কেউ বড় হওয়ার পর বন্ধুত্ব নিয়ে বিভ্রান্তির শিকার হতো না। ছেলে দুটির সঙ্গে তোমার যে ধরনের কথাবার্তা হতো তা থেকে বোঝার চেষ্টা করতে পারো, ওরা তোমাকে কী দৃষ্টিতে দেখেছিল। পরিবারের বাইরে গড়ে ওঠা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের কাছেই স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, সম্পর্কটিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। এর মধ্যে অস্পষ্টতা থাকলে বেশ জটিলতার উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমাকে ভালো করে বুঝতে হবে, এই ছেলেগুলোর বন্ধুত্ব বা মনোযোগ তোমার কতটুকু প্রয়োজন। তোমাকে কিন্তু নিজের প্রতি পরিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং অন্যান্য সহপাঠীর সঙ্গে আদান-প্রদানের সুন্দর, সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে প্রথমে তাদের শুধু বন্ধু ও সহপাঠী হিসেবে দেখবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ দেখানো খুব সুস্থতা নির্দেশ করে না, এটি মনে রাখবে। কোনো সদ্য পরিচিত মেয়ে-বন্ধুর সঙ্গে তুমি যেভাবে গল্প করো, ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্বও তেমন হওয়া দরকার।
সমস্যা: আমি অতিরিক্ত বদমেজাজি, সব সময় হীনম্মন্যতায় ভুগি। তিন বছর ধরে আমার এই সমস্যাগুলো চলছে। এতে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না এবং কোনো কাজেই সফল হতে পারি না। বর্তমানে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাই না। আমার কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা নেই। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না, আবার মরতেও পারি না—এ রকমভাবে বেঁচে আছি। আমার বদমেজাজ ও হীনম্মন্যতা আমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
প্রীতি
পরামর্শ: এত অল্প বয়সে এতটা কষ্টের ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছ, এটা খুব দুঃখজনক। পড়ালেখা বন্ধ করেছ কি পরীক্ষায় ভালো ফল হচ্ছিল না বলে? তোমার খুব রাগ আর হীনম্মন্যতার কথা জেনে মনে হচ্ছে, তুমি তোমার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে একেবারেই ভাবছ না। হয়তো বা সব সময় তোমার মধ্যে যে নেতিবাচক দিকগুলো রয়েছে বলে তোমার মনে হয়, সেগুলো নিয়েই বেশি ভাবছ। কোনো কাজে ভুল হলে বা অকৃতকার্য হলে নিজেকে হয়তো খুব বেশি দোষারোপ করছ। এই মনোভাবের কারণে নিজেকে প্রায়ই গুরুত্বহীন মনে হওয়ায় অনেক রাগ ও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আমরা যখন নিজেদের ভুলগুলো এবং ব্যর্থতাকে একেবারে মেনে নিতে পারি না, তখন অন্যদের প্রতিও সমালোচনামূলক মনোভাব পোষণ করি এবং অন্যদের আচরণে হয় খুব রেগে যাই নয়তো কষ্ট পাই। রাগের কারণে আশপাশের মানুষদের সঙ্গেও তোমার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব বিষয়ই হয়তো তোমার মধ্যে বিষণ্নতা তৈরিতে অবদান রাখছে এবং কোনো কিছুতেই তাই তুমি উৎসাহ পাচ্ছ না। তুমি লিখেছ, সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করতে চাও। সেটি করতে হলে প্রথমে নিজের ভেতরের সত্তাটিকে পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করে নিতে হবে। ভুলভ্রান্তি যা-ই করো না কেন, নিজেকে বলবে, ‘মানুষমাত্রই ভুল করে, প্রীতি, তুমিও ভুল করে ফেলেছ। তবে এর পরও আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। নিশ্চয়ই তুমি যথেষ্ট আন্তরিক হলে এই ভুলগুলো পরবর্তী সময়ে শুধরে নিতে পারবে।’ এ ছাড়া অতীতে যা যা ভালো কিছু করেছ, সেগুলোর জন্য নিজেকে প্রশংসা করবে এবং ভবিষ্যতে সফল হতে পারবে—এই আস্থা নিজেকে দেবে। তোমার মধ্যে যেসব ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে এবং ছেলেবেলা থেকে এ পর্যন্ত যে কাজগুলো করে তুমি গর্বিত ও প্রশংসিত হয়েছ, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করবে। প্রতিদিন অন্তত একটি-দুটি করে গুণাবলি যোগ করবে তোমার তালিকায়। এতে তোমার নিজের প্রতি আস্থা বাড়বে।
তবে তোমার বিষণ্নতার মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গেলে আমি অনুরোধ করব ঢাকায় এসে কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলরের কাছে সাইকোথেরাপি নিতে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৫, ২০১০
Leave a Reply