‘আজকাল অনেক পরিবারেই দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী। সেই পরিবারে যদি কাজের লোক কয়েক দিন ধরে অনুপস্থিত থাকে, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে বাড়ির মানুষের। এর সমাধান কিন্তু খুব বেশি কঠিন নয়। পারস্পরিক সহযোগিতায় রচনা করা যায় সুন্দর সুখের নীড়’—বলছিলেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফিরোজা সুলতানা। সংসার পরিচালনার নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন তিনি।
পারস্পরিক সহমর্মিতা
একে অন্যের প্রতি সহমর্মী হলে সংসার সামলানো খুব বেশি কঠিন হয় না। স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী হলে অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রীর ওপর বেশি কাজের চাপ পড়ে। আপনি একজন সহানুভূতিশীল স্বামী হোন, অবশ্যই স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করুন। স্ত্রীর ওপর কাজের বোঝা চাপিয়ে দেবেন না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীরও দায়িত্ব রয়েছে। যদি স্বামী বিষয়টি না বোঝেন, তবে রাগারাগি না করে তাঁকে ঠান্ডা মাথায় বোঝানোর পরামর্শ দেন ফিরোজা সুলতানা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ছেলেমেয়ের ভূমিকাও যোগ করতে পারেন। মায়ের কাজে টুকটাক সাহায্য করতে পারে তারা। এতে কাজের চাপটা বেশ কমে যাবে।
পরিকল্পনা করুন
শুরুতেই কাজের পরিকল্পনা করে নিন। এতে সব কাজ সময়মতো হয়ে যাবে, পাশাপাশি কোনো কাজ বাদ পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সারা দিনের কাজের একটা পরিকল্পনা তৈরি করুন। পরিকল্পনাটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারেন—নিজের, স্বামীর, সন্তানের কাজ। ঘরের ও বাইরের কাজগুলোও আলাদা রাখতে পারেন। কাজের সঙ্গে সময়টা উল্লেখ করতে ভুল করবেন না। একটু সময় হাতে রেখে দিন হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ কিংবা অনেক দিন পর আপনার বাড়িতে আসা প্রিয় বন্ধুকে আপ্যায়ন করার জন্য।
কাজের ভাগাভাগি
দশের লাঠি একের বোঝা—এ কথাটি কিন্তু সংসারের কাজের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। নিজের ওপর সব কাজের বোঝা না নিয়ে স্বামী-সন্তানকে কাজ ভাগ করে দিন। পরিবারের সবার মধ্যে নিজের কাজটা নিজে করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, যেমন—খাওয়ার পর নিজের থালা ধুয়ে নেওয়া, নিজের ঘর গোছানো, জামাকাপড় গোছানো ইত্যাদি। ছেলেমেয়েকে স্বাবলম্বী করে তুলুন। স্কুলের ব্যাগ গোছানোর দায়িত্ব তাদের দিয়ে দিন। জুতার ফিতা বাঁধা, চুল আঁচড়ানো, ঘড়ি পরা, টাই বাঁধা সময় করে শিখিয়ে দিন। দেখবেন, তারা নিজে নিজে এ কাজগুলো করতে আনন্দ পাবে।
আপনার স্বামীর চশমা, ঘড়ি তাঁকে সব সময় এক জায়গায় রাখতে বলুন। এতে অফিসে যাওয়ার সময় খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট হবে না। ছেলে বা মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দিলে তাদের স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার কাজটি স্বামীও করতে পারেন।
কাজ সহজ করে নিন
আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে। তাই একে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে নিন। সকালের নাশতা দ্রুত তৈরি করতে ব্যবহার করতে পারেন ইলেকট্রিক টোস্টার। জামাকাপড় ধোয়ার জন্য নিতে পারেন ওয়াশিং মেশিনের সাহায্য। ভাত চুলায় না চড়িয়ে রাইস কুকারেও দিতে পারেন। অল্প সময়ে রান্না ও খাবার গরম করতে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের তো জুড়িই নেই। ঘর পরিষ্কার ও ধুলাবালি দূর করতে সাহায্য নিন ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের। এর ব্যবহারটা আপনার বড় সন্তানকে এক ফাঁকে শিখিয়েও দিতে পারেন। এ ছাড়া ওভেনে খাবার গরম করা শেখাতে পারেন। নিজের প্রয়োজনমতো সে নিজের খাবারটা গরম করে নিতে পারবে। গ্যাসের চুলায় পানি গরমের ঝামেলাটা মিটিয়ে নিতে পারেন গিজার ব্যবহার করে। স্বামী-সন্তানের গোসলের পানিটা তারা নিজেরাই গরম করে নিতে পারবে।
সময় বাঁচান
একসঙ্গে দুটি কাজ করা যায় এমন কাজগুলো একবারে সেরে ফেলুন। যেমন—বাচ্চাকে পড়াতে পড়াতে ঘরটা গুছিয়ে নিন। খবর শুনতে শুনতে কেটে ফেলুন রান্নার জন্য সবজি। রান্না বসিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় ফোনগুলো করে নিতে পারেন। ঝটপট তৈরি হয়ে সবাই একসঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ুন। বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যান। স্ত্রী বা স্বামী যাঁর অফিস থেকে বাচ্চার স্কুল কাছে, তিনি ফেরার পথে বাচ্চাকে নিয়ে আসুন। ফেরার পথে রাস্তায় বাজার পড়লে সেটাও সেরে নিন। এতে আলাদা করে বাজারে যাওয়ার সময়টা বেঁচে যাবে। ঘরে অতিথি আপ্যায়ন করা যায় এমন কিছু উপাদান সব সময় রেখে দিন। পানি, বিদ্যুৎ বা ফোন বিলটা ব্যাংকে না গিয়ে ফোন থেকেই দিয়ে দিন। এতে সময় বাঁচবে। ছুটির দিনে জমিয়ে রাখা কাজগুলো সেরে নিন। পাশাপাশি কাজ কিছু এগিয়েও রাখতে পারেন, যেমন—জামাকাপড় ইস্ত্রি করে রাখা। এ ধরনের কাজ স্বামীও করতে পারেন। ছুটির দিনে ছেলেমেয়ের বাড়ির কাজগুলোও দেখে দিতে পারেন। এ ছাড়া বারান্দায় রাখা ফুলের টবের পরিচর্যাটা ছেলেমেয়ের ওপর দিতে পারেন।
জরুরি সময় মোকাবিলায়
বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না, তাই এর জন্য প্রস্তুতিটা আগে থেকেই রাখুন। আপনার ব্যাগে পরিচয়পত্র আর প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরগুলো রাখার পাশাপাশি আপনার বাচ্চার স্কুলের ব্যাগেও তা ঢুকিয়ে দিন। ওকে বাসার ঠিকানাটা মুখস্থ করিয়ে রাখুন। ঘরে একটা প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স রাখুন। সেটা কোথায় আছে সবাই যেন জানে, সে বিষয়টা খেয়াল রাখুন। বৈদ্যুতিক তার, সুইচ মাঝেমধ্যে পরীক্ষা করিয়ে নিতে ভুলবেন না যেন।
পারিবারিক বিনোদনে
পরিবার সামলানোর পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও সমান গুরুত্ব দিন। ছুটির দিনে সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসুন। ব্যস্ততার জন্য সেটি করতে না পারলেও সমস্যা নেই। রাতের খাবারটা একসঙ্গে খেয়ে সবাই মিলে বসে পড়ুন ভালো কোনো চলচ্চিত্র দেখতে। অবসরের বিকেলটা কাটিয়ে দিতে পারেন ছেলেমেয়েসহ সাপলুডু খেলে। সবার মাঝে যখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে তখন আর কী চিন্তা। সব সম্পর্ক, আর সব সুখের ভিত্তিই হচ্ছে বন্ধুত্ব। তাই না!
শান্তা তাওহিদা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০১০
Leave a Reply