ধরুন, আপনি এমন এক এলাকায় থাকেন, যেখানে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। প্রতিবছর বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় কিংবা এমনও হতে পারে শাকসবজি করার মতো আপনার কোনো জমি-জিরেতও নেই, অথচ নিজের ফলানো শাকসবজি খাওয়ারও ইচ্ছা মনে। তাহলে কি আপনি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? মোটেই না। পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়নকেন্দ্র নামের একটি বেসরকারি সংস্থা উদ্ভাবন করেছে অল্প জায়গায় শাকসবজি চাষের পদ্ধতি। বিশেষ এ কৌশলের নাম ব্যাগে বহু স্তরে সবজি চাষ বা ব্যাগ গার্ডেনিং। এ ব্যবস্থায় বড় ব্যাগের ভেতর মাটি দিয়ে শাকসবজি চাষ করা হয়। এর প্রধান সুবিধা হচ্ছে প্রয়োজনমতো আপনি ব্যাগটি সরিয়ে নিতে পারবেন। এ ব্যবস্থায় সারা বছর কয়েকবার শাকসবজিও তোলা যাবে। পদ্ধতিটি ছোটখাটো পরিবারের জন্য একেবারে লাগসই। তবে খেতের সবজির মতো বড় আকারে ফলন এখানে পাওয়া যাবে না।
সপ্তাহখানেক আগে সংস্থাটির গাজীপুরের ভবানীপুর খামারে গিয়ে ব্যাগ গার্ডেনিংয়ের প্রদর্শনী প্রকল্প দেখার সুযোগ হয়েছে। কয়েকটি কৃত্রিম তন্তুর (সিনথেটিক) তৈরি ব্যাগে চারটি স্তরে বোনা হয়েছে শাকসবজি। এর একটিতে পুঁইশাকের ডগাগুলো ঝুলছে। পাতাগুলো বেশ সতেজ। আরেকটিতে আছে কলমিশাক। কোনোটিতে আছে ডাঁটাশাক। ব্যাগগুলোর চারপাশে বিভিন্ন স্তরে লাগানো হয়েছে ঢ্যাঁড়শ, মরিচ ও অন্যান্য শাক। একটি ঘরের আঙিনায় লাগানো হয়েছে লাউ-কুমড়োর গাছ। গাছগুলো দিব্যি বেড়ে উঠছে। এ পদ্ধতিতে পাতাবহুল শাকের উৎপাদন অতি চমৎকার। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বর্ষজীবী ফলও চাষ করা সম্ভব। ছাদেও এ ধরনের বাগান অনায়াসেই করা যায়। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, শুধু দুর্যোগপ্রবণ এলাকায়ই নয়, এ পদ্ধতি বাংলাদেশের সর্বত্রই লাগসই। অর্থাৎ ছাদে, বারান্দায়, আঙিনায়—সর্বত্রই এ পদ্ধতিতে শাকসবজি পাওয়া যাবে। বিশেষত, আমাদের দেশে যেখানে জনসংখ্যার বিপরীতে বসবাসের জায়গা কম, সেখানে ব্যাগ গার্ডেনিং কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সংস্থাটির কৃষি ও পরিবেশ বিভাগের পরিচালক শেখ তানভীর হোসেন জানান, ২০০৯ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যাগ গার্ডেনিংয়ের প্রদর্শনী প্রকল্প চালু করা হয়েছে। বাজারে গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির স্বল্পতার কথা বিবেচনা করেই এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চাষের পদ্ধতি
এ প্রকল্পটির দেখভাল করছেন পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়নকেন্দ্রের প্রোগ্রাম কর্মকর্তা সালমা আক্তার। কথায় কথায় তিনি চাষ-পদ্ধতির কৌশলও জানিয়ে দেন। প্রথমেই একটি বড় আকৃতির সিনথেটিক বস্তা নিতে হবে। তারপর বেশি পরিমাণ জৈব সার মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে। মাটিতে অধিক সময় ধরে পানি ধরে রাখার জন্য বস্তার নিচে তিন-চার কেজি শুকনো পাতা বা খড় বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রস্তুত করা মাটি দিতে হবে বস্তায়। মাটি যেন জমাট বাঁধতে না পারে সে জন্য বস্তার ঠিক মাঝখানে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ২০ থেকে ৪০ মিমি মাপের ইটের টুকরো বা খোয়া দিতে হবে। খোয়াগুলো ভালোভাবে বসানোর জন্য একটি পিভিসি পাইপ ব্যবহার করা যেতে পারে। কাজ শেষে পাইপটি অবশ্যই খুলে ফেলতে হবে। বীজ বপন করে চাষ করতে পারেন। তবে চারা তৈরি করে লাগিয়ে দেওয়াই ভালো। সালমা আক্তার মনে করেন, বহু স্তরবিশিষ্ট শাকসবজি চাষ বাংলাদেশে একটি নতুন ধারণা। প্রথম দিকে দৈনিক ১৮ লিটার পানি সেচ করতে হয়। কিছু দিন পর অবশ্য সকাল-বিকেল তিন লিটার করে সেচ দিলেই হয়। আর বৃষ্টি হলে দু-তিন দিন না দিলেও সমস্যা হয় না।
এ পদ্ধতির চাষাবাদ একেবারেই যে আনকোরা তা নয়। আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়া ও উগান্ডার বস্তি এলাকায় ফ্রান্সভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘সলিডারিটিস’ বেশ কিছুদিন ধরে সফলতার সঙ্গে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে আসছে এবং তাতে সফলতাও এসেছে।
মোকারম হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০১০
Leave a Reply