ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম দীর্ঘদিন ধরে কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিষয়টি পড়াচ্ছেন। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন। আপনার সঠিক পরিচয় না দিতে চাইলে অন্য কোনো নাম ব্যবহার করুন। —বি.স.
সমস্যা: আমি দেড় বছর ধরে একটা ছেলেকে ভালোবাসি। ছেলেটা অবশ্য আমাকে ভালোবাসে প্রায় দুই বছর যাবৎ। সাত-আট মাস আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে নতুন এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর জানলাম, নতুন বন্ধুটি আমাদের এলাকাতেই থাকে। আমি যে ছেলেটাকে ভালোবাসি, সে আমাদের বাসা থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে থাকে। তাই ওর সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয় না। বরং নতুন বন্ধুটার সঙ্গে হয় বা হতো। নতুন বন্ধুটি আমার সঙ্গে বা আমিই ওর সঙ্গে অনেক মিশেছি। ঘোরাঘুরিও অনেক করেছি। ওর প্রতি একটা আবছা ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। সে আমার বাসায়ও এসেছে। হঠাৎ একদিন ও আমাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়। ও জানত, আমি অন্য একটা ছেলেকে ভালোবাসি, তবুও। যাকে ভালোবাসি, সে ছিল মাদকাসক্ত। তাকে আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলাম। এতে আমার বন্ধুটি আমাকে বারবার নিরুৎসাহিত করে বলেছিল, ও কখনো ভালো হবে না এবং এই বলে সে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করছিল। আমি ওকে কেবল বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও খুব উৎপাত শুরু করলে আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। এতেও সে আরও খেপে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছে। এমনকি ওই ছেলে আর আমার কথা বাসায় জানিয়ে দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তুমি লিখেছ, দেড় বছর ধরে একটি ছেলেকে ভালোবাসো এবং সে মাদকাসক্ত। যদি তাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকো, তাহলে তো আরেকটি ছেলের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়াটা নৈতিকতাবিরোধী, নয় কি? অতিরিক্ত মেলামেশার ফলে দ্বিতীয় ছেলেটি যে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছিল, সেটাও নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছিলে। কাজেই এ ব্যাপারে তখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। মনে হচ্ছে, তুমি তোমার ‘ভালোবাসার’ এবং ‘ভালো লাগার’ মানুষ দুটোর প্রতি আন্তরিক ছিলে না বলেই এই মনস্তাত্ত্বিক খেলার অবতারণা হয়েছে। তুমি আসক্তিতে থাকা ছেলেটির উদ্ধারকর্তা হিসেবে এই সম্পর্কে ঢুকেছিলে। কিন্তু বুঝতে পারোনি, যেকোনো আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ওই মানুষটিরই প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়। শুধু ভালোবাসা দিয়ে অন্য একজনের নেশার ইচ্ছা দূর করা কখনো সম্ভব নয়। অনেক মেয়ের ধারণা, প্রেমের সম্পর্কটি ব্যবহার করে মাদকাসক্তি দূর করা সম্ভব। কিন্তু যে মানুষটি আসক্ত, তার প্রথম প্রেম হচ্ছে মাদক। আর তাই মেয়েটিকে একটি কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় এবং অধিকাংশ সময় হতাশা নিয়ে চলতে হয়। তোমার হতাশা দূর করার জন্য নতুন বন্ধুটি কিছুদিন উদ্ধারকর্তার ভূমিকায় ছিল। পরে তোমার ভূমিকাটি নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হওয়ায় সে এখন আক্রমণকারীর ভূমিকায় নেমেছে। আর তাই তোমাকে হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তোমার পরিবারেও তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কাজেই বুঝতেই পারছ, তুমি মনের অজান্তেই একটি ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো, আসলে তুমি কী চাও। যদি এই দুটো সম্পর্কের মধ্যে একটিও তোমার জন্য মঙ্গলজনক না হয়, তাহলে তো এগুলো থেকে বেরিয়ে এসে জীবন গড়ার পরিকল্পনা করলে ভালো হয়। বাড়ির লোকজনকে বুঝিয়ে বলো, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ এবং এখন থেকে লেখাপড়ার মনোযোগী হও। যে ঘটনাটি ঘটে গেছে, আশা করি, সেখান থেকে শিক্ষাটুকু নিলে তুমি ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপদে পড়বে না।
সমস্যা: আমার বয়স ২০ বছর। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। এসএসসি পাস করেছি ২০০২ সালে। আমরা তিন ভাইবোন। আমি সবার ছোট এবং সবার আগে আমার বিয়ে হয়। বড় বোন এখন চাকরি করেন। তাঁর এখনো বিয়ে হয়নি। বড় ভাই এবার সম্মান শেষ বর্ষে। তাঁরা সবাই আমাকে পড়াতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমার মেধা খুবই কম। আমি বিয়ের পর নিজেকে খুব ঘৃণা করি এবং সব সময় মৃত্যু কামনা করি। আমি প্রায় সময় মানসিক সমস্যায় ভুগি। বিয়ের আগে খুব চঞ্চল ও দুষ্ট ছিলাম। এখন কোনো হাসি, আনন্দ, উৎসব ভালো লাগে না। সব সময় লোকালয় ছেড়ে নির্জনতায় থাকতে ভালো লাগে। প্রতিদিন আমি কাঁদি। আমি যাকে বন্ধু ভেবে দুঃখের কথা বলতে যাই, সে-ই আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।
মোহনা
যশোর।
পরামর্শ: তোমার বিয়ের ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে লেখোনি। কত দিনের বিবাহিতজীবন ছিল এবং কী কারণে বিচ্ছেদ হয়েছে, তাও উল্লেখ করোনি। তোমরা কি নিজেরাই বিয়ে করেছিলে? আইনগতভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে কি না, সেটাও জানতে পারলাম না। লিখেছ, বিয়ের পর থেকে তুমি নিজেকে ঘৃণা করছ। তখন কি এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে? বর্তমানে যে তোমার খুব বেশি বিষণ্নতা কাজ করছে, সেটি চিঠিপত্রে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তুমি যদি সারাক্ষণ জীবন সম্পর্কে আর নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তার আবর্তে থাকো, তাহলে তো লোকে তোমাকে দুর্বল ভাববে এবং তাদের আচরণ থেকে কষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ার কথা। তাই এই দুষ্টচক্র থেকে নিজেকেই নিজের বের করে আনতে হবে। মাত্র ২০ বছর বয়সে তুমি কেন হাল ছেড়ে দেবে বলো তো? আমি নিশ্চিত যে তোমার মধ্যে অনেক প্রতিভা ও সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। সেটাও যেটুকু আছে, তা কাজে লাগাতে পারলে তুমি নিশ্চয়ই কিছু অর্জন করতে সক্ষম হবে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বিছানায় শুয়ে বা ইজি চেয়ারে বসে শরীর সম্পূর্ণ রিলাক্স করে অনেক বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে কয়েকবার ছাড়বে। নিঃশ্বাস গ্রহণ করার সময় মনে মনে বলবে, ‘আমাকে সাহস, শক্তি, প্রেরণা দাও।’ নিঃশ্বাস ছাড়ার সময়ও বলবে, ‘আমার সব কষ্ট, ভয়, হতাশা দূর করে দাও।’
এ ছাড়া নিজের প্রতি সদয় হয়ে নিজের নামটি ধরে ডেকে বলবে, ‘মোহনা, অন্য কেউ তোমাকে না বুঝলেও আমি তোমাকে বুঝি এবং তোমাকে অনেক ভালোবাসি ও শ্রদ্ধা করি। এই কাজগুলো খুব আন্তরিকভাবে প্রতিদিন করতে পারলে উপকার পাবে। মনটা একটু ভালো হতে থাকলে আবার লেখাপড়া করবে, কেমন? তোমার বিশেষ কোনো হাতের কাজ বা শিল্পে আগ্রহ থাকলে সেগুলোর কোর্স করতে পারো। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে কিন্তু বিষণ্নতা অনেক কমে যাবে। অনেক শুভকামনা রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৯, ২০১০
Leave a Reply