এখন সকাল ছয়টা। সাতটায় মৃত্তিকার স্কুল। এবার নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে সে। তাকে ঘুম থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন ফুফু নিতু। ‘উঠে পড়ো মৃত্তিকা, স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ মৃত্তিকার আকুতি, ‘তুতু, আরেকটু পর উঠব।’ কিন্তু সময় তো আর বসে থাকে না। তাই এক ঝটকায় মৃত্তিকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ব্রাশ করিয়ে পরানো হয় স্কুলের পোশাক। মৃত্তিকা সকালের নাশতাটাও করে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। এরপর স্কুলের ভ্যানগাড়িতে কোনো রকম তুলে দেওয়া হয় তাকে। একবারও চিন্তা করা হয় না, ছোট্ট এই মেয়েটি ঘুম-জড়ানো চোখে আদৌও ক্লাসগুলোতে মনোযোগ দিতে পারবে কি না। একই সমস্যা ইফতিকে নিয়েও। অনেক রাত পর্যন্ত কার্টুন দেখে সকালে উঠতে চায় না সে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া ইফতির স্কুল আটটায়। ঘুম থেকে ওঠার তাগাদা দিতেই ইফতি বলে, ‘আর পাঁচ মিনিট, আম্মু।’ একপর্যায়ে তার মা বকা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে স্কুলের জন্য তৈরি করে ইফতিকে। ঘুম ঘুম চোখেই সে মায়ের সঙ্গে রিকশায় উঠে বসে স্কুলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চারা সাধারণত খেতে চায় না বা স্কুলে যেতে চায় না। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এমন বিড়ম্বনা প্রায়ই পড়তে হয় মাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন বলেন, ‘আমার এক বাচ্চা প্লে গ্রুপে পড়ে, অন্যজন পঞ্চম শ্রেণীতে। দুজনের স্কুলই সকালে। কিন্তু ওরা স্কুলে যাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা করে না।’ তিনি বলেন, যেকোনো কাজই অভ্যাস-নির্ভর। শিশুদের ঘুম থেকে ওঠা বা খাওয়ার বিষয়টা নির্ভর করে অভ্যাসের ওপর। সকালের সময়টা পড়াশোনা করা বা স্কুলের জন্য উৎকৃষ্ট সময়। এ ছাড়া সকালে ঘুম থেকে উঠলে শিশুদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। তাই শিশুকে স্বাবলম্বী করতে আগের রাতেই স্কুলের ব্যাগটা গুছিয়ে রাখতে বলি।
ইরাজ পড়ছে কেজিতে। তার মা তানিয়া বলেন, ‘ইরাজের স্কুলের প্রতি আগ্রহটা অনেক বেশি। তবে কখনো কখনো সকালে উঠতে একটু কষ্ট হয়। বিশেষ করে, যে রাতে অনেকক্ষণ কার্টুন দেখে। সকালবেলা ও কিছু খেতে চায় না তাই শক্ত খাবার না দিয়ে কিছুটা তরল খাবার খেতে দিই।’ ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের শিক্ষক পারভিন বানু বলেন, আগে কিন্তু শিশুরা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেত। কিন্তু এখন তারা অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। এ কারণে তারা ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে। ঘুমের ঘাটতি থাকায় বাচ্চারা ক্লাসে এসে মনোযোগী হতে পারে না। কখনো আবার স্কুলে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই শিশুকে দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া এবং সকালে ওঠার অভ্যাস করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিশু বর্ধন ও পরিচর্যা বিভাগের সাবেক অধ্যক্ষ মোর্শেদা বেগমের মতে, শিশুর ঘুম নির্ভর করে তার ও পরিবারের সদস্যদের অভ্যাসের ওপর। প্রথমত, শিশুর ঘুমের জন্য পরিবেশ আগে তৈরি করে দিতে হবে সবার আগে। বেশি রাত না জেগে দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে এবং একইভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া সকালের বাতাস শিশুর শরীরের জন্য ভালো। যেহেতু সকালে শিশুরা খেতে চায় না, তাই স্কুলের টিফিন একটু ভারী হওয়া দরকার। শিশুকে দুপুরে ঘুমের অভ্যাস করানো উচিত। এ ছাড়া আগের রাতেই পড়া শেষ করে স্কুলের ব্যাগটা গুছিয়ে রাখার অভ্যাস করাতে হবে। এভাবেই ওরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করেন মোর্শেদা বেগম।
টিপস
শিশুকে রাতে দ্রুত ঘুম পাড়িয়ে দিন।
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠানোর অভ্যাস করান।
সকালে শক্ত খাবার না খেতে পারলে তরল খাবার দিন।
টিফিনটা হওয়া দরকার ভারী।
আগের রাতেই স্কুলের ব্যাগ ও পোশাক গুছিয়ে রাখা উচিত।
শিশুকে না ধমকিয়ে বুঝিয়ে বলা উচিত।
শারমিন নাহার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০১০
Leave a Reply